কিশোরগঞ্জের দৃষ্টিনন্দন গাংগাটিয়া জমিদার বাড়ি
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জমিদার বাড়ি। জমিদারদের তৈরি বাড়িগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন রকমের ইতিহাস। অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন নিদর্শন ও ঐতিহাসিক স্থাপনায় ভরপুর কিশোরগঞ্জ।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক বাহক হিসেবে কিশোরগঞ্জের গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি অন্যতম। দৃষ্টিনন্দন গাংগাটিয়া জমিদার বাড়িটির গোড়াপত্তন হয় ব্রিটিশ শাসনামলের শেষের দিকে। এই জমিদার বাড়ির আছে অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এই জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ভোলানাথ চক্রবর্তী। অন্যান্য জমিদার বাড়ির মতো এটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত না হয়ে এখনো পুরোপুরি টিকে আছে।
কিশোরগঞ্জের প্রাচীন নিদর্শনগুলোর মধ্যে হোসেনপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি ও জমিদার মানব বাবুর সুবিশাল মাছের খামার প্রকৃতির অন্যতম সৌন্দর্য্য বহন করে। প্রায় প্রতিদিনই জমিদার বাড়িটি দেখতে ভিড় জমায় অনেক দর্শনার্থীরা। জমিদারিত্ব না থাকলেও শেষ জমিদারের ছেলে শ্রী মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরী (মানব বাবু) এখনো বেঁচে আছেন। তিনিই বাড়িটির রক্ষণশীল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মানব বাবুর বয়স এখন ৯১ বছর।
জমিদার বাড়ির সুবিশাল কারুকার্যময় বাড়ির মূল ফটকে শ্রীধর ভবন লেখা রয়েছে সুস্পষ্টভাবে। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন এই জমিদার বাড়িটি ১৮ শতকের গ্রীক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত। জমিদার বাড়ির সামনেই রয়েছে সুবিশাল পুকুর। বাড়িটিতে রয়েছে নহবতখানা, কাছারিঘর, দরবারগৃহ ও মন্দির। দরবারগৃহে এখনো শত বছরের পুরোনো কিছু আসবাবপত্র রয়েছে।
মানব বাবুর বাড়ির উত্তরপাশে রয়েছে সুবিশাল মাছের খামার। বর্তমান জমিদারের শেষ বংশধর মানব বাবু জমিদার বাড়িটি সংস্কার করে নতুনত্ব করে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার পিতা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পরে মানব বাবু সেখানে একটি সমাধি সৌধ তৈরি করেন।
মানব বাবু জমিদার বংশের বর্তমান উত্তরাধিকারী মানবেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী চৌধুরীর নামানুসারে পরিচিত। তাদের অতি প্রাচীন এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করা হয় ১৮ শতকের প্রথম দিকে। দীননাথ চক্রবর্তীর হাত ধরে জমিদারির যাত্রা শুরু হয়। তিনি ইংরেজদের কাছ থেকে হোসেনশাহী পরগনার একটি অংশ কিনেন কিন্তু ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাবু অতুলচন্দ্র চক্রবর্তী “পত্তনি” সূত্রে আঠার বাড়ির জমিদার জ্ঞানদা সুন্দরী চৌধুরাণীর কাছ থেকে দুই-আনা অংশ গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি জমিদারিত্বে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই জমিদার বংশের আদি বাসস্থান ছিল ভারতের কাইন্নকব্জিতে। প্রায় ৬০০ বছর আগে তারা সেখান থেকে হোসেনপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন। তারপর দেশ বিভক্ত হওয়ার পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে জমিদারিও শেষ হয়ে যায়।
ঘুরতে আসা কয়েকজন দর্শনার্থী জানায়, মানব বাবুর জমিদার বাড়িটি অনেক পুরোনো। অবসর সময় কাটাতে এখানে কিছু সময়ের জন্য বেড়াতে আসি। মানব বাবুর বাড়িতে আসলে মনে হয় কোনো রাজপ্রাসাদে এসেছি। ওনার মাছের ফিসারিগুলোও দৃষ্টি নন্দিত। চোখের প্রশান্তি আর সবুজ প্রকৃতি উপভোগের জন্য মানব বাবুর বাড়ি এখানকার সকলের কাছেই জনপ্রিয় জায়গা।
মানব বাবু জানান, বাড়িতে ঘুরতে আসা অনেক মানুষজন বাড়ির বিভিন্ন অংশের ক্ষতি করে, ভেঙে ফেলে। এজন্য বাড়ির অনেক জায়গায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর অনেক দিন ধরে কোনো সংস্কার না করার কারণে জমিদার বাড়ির কিছু কিছু অংশ ভেঙে যায়। ইংল্যান্ড থেকে আনা টাইলসগুলোর অনেকেই ক্ষতি করছে, ভেঙে ফেলছে সেগুলো আবার পুনরায় মেরামত করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বাড়ির দরবারগৃহের মেঝেতে সন্ধ্যায় সঙ্গীত প্রেমীরা ঢোল, তবলা, হারমোনিয়াম, করতাল, ঝাঁজ, বাঁশি, খোল, একতারা ইত্যাদি বাজিয়ে গানের আসর জমায়।
নিজেও গানের আসরে নিজ কন্ঠে গান পরিবেশন করেন মানব বাবু। জীবনের শেষ সময়ে এসে হাসি আনন্দের মাঝে আরও বেশ কিছু দিন বেঁচে থাকার চেষ্টা তার।
এসআইএইচ