চায়ের নার্সারির গ্রাম বিরাজোত
পঞ্চগড়ের সদর উপজেলার সীমান্ত ঘেষা প্রত্যন্ত গ্রাম বিরাজোত। গত কয়েক বছর আগেও এই গ্রামের মানুষ ছিল অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল। ৫ থেকে ৭ বছর আগেও এই গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ি ছিল ছনের তৈরি কাঁচা ঘর। এখন সেই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের বাড়িতে গড়ে উঠেছে পাঁকা ঘর। চক চক করে জানালার থাই গ্লাস। বাড়ি বাড়ি বাইসাইকেলের বদলে হয়েছে মোটরসাইকেল। যেতে হয় না আর পাথর উত্তোলন কিংবা অন্যের জমিতে কাজ করতে ৷ প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের পরিবর্তন হয়েছে চা গাছের চারার নার্সারি করে। এই গ্রামের উৎপাদিত চায়ের চারা জেলার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে সিলেট, মৌলভীবাজার ও চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায়। ফলে দিন দিন অর্থনৈকভাবে ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে গ্রামটি।
জানা গেছে, জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত বিরাজোত গ্রামটি। চারদিকে সবুজের সমারোহে গ্রামটি বেশ মনোরম। গ্রামের ভেতর ঢুকলে চোখে পড়েবে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে খড়ের তৈরি শেড। আর এই সেডের নিচেই করা হয়েছে চায়ের নার্সারি। জেলার চায়ের কথা উঠলেই সবার মুখে চলে আসে এই বিরাজোত গ্রামের নাম। আশপাশের এলাকার মানুষের কাছে গ্রামটি পরিচিত পেয়েছে চায়ের নার্সারির গ্রাম হিসাবে। গ্রামটির বেশির ভাগ আবাদী জমিই এখন চায়ের নার্সারি। বিভিন্ন নার্সারিতে মালিক-শ্রমিকরা পরিচর্যার কাজ করছেন। অনেকেই আবার বাইরে থেকে চারা কিনতে আসা ক্রেতাদের সঙ্গে চারা বিক্রিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
স্থানীয়রা জানান, বিরাজোত গ্রামে ১২০ থেকে ১৩০টি পরিবারের বসবাস। কিন্তু এই পরিবারগুলোর কম-বেশি সবাই চা নার্সারির সঙ্গে যুক্ত। এই গ্রামের মানুষের দেখাদেখি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলেতেও বাড়ছে চায়ের নার্সারি।
নার্সারি মালিকরা জানান, কেউ নিজস্ব জমিতে আবার কেউ কেউ অন্যের জমিতে ভাড়া (চুক্তি) নিয়ে গড়ে তুলেছেন এই নার্সারি। প্রতিটি নার্সারিতে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ আড়াই থেকে তিন লাখ পর্যন্ত চারা তৈরি করা হয়।
বিরাজোত গ্রামের চায়ের নার্সারি দেখে পার্শ্ববর্তী ডাঙাপাড়া, কামারপাড়া, পতিপাড়া, বন্দিপাড়া ও সাহেবিজোত গ্রামেও শুরু হয়েছে নার্সারি ব্যবসা। প্রতিটি চারা ৫ থেকে ১৫ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। এতে বেকার মানুষদের যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে তেমনি গ্রামের মানুষের জীবন মানও উন্নয়ন হয়েছে।
জেলা চা বোর্ড জানায়, পঞ্চগড় জেলায় এখন পর্যন্ত মোট ২১টি চা নার্সারি নিবন্ধন নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিরাজোত গ্রামের সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া নিবন্ধনের বাইরে শতাধিক নার্সারি রয়েছে। মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চাষের মৌসুম চলাকালে এই নার্সারি করা যায় বলে জানায় চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। নার্সারি মালিক ও চাষিরা জানান, চা চারার সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো ঝড়, বৃষ্টি ও বাতাস।
চা নার্সারি কৃষক জমির উদ্দিন বলেন, আগে আমাদের গ্রামের মানুষেরা ধান, গমের চাষ করত। এতে তেমন লাভবান হতে পারত না। কিন্তু হঠাৎ করে কয়েক বছর আগে চায়ের নার্সারি শুরু হলে এই গ্রামের কৃষকদের জীবনের পরিবর্তন আসে। এখন এই গ্রামের প্রতিটি কৃষকদের রয়েছে চায়ের নার্সারি। আমিও চায়ের নার্সারি করে স্বাবলম্বী হয়েছি।
বিরাজোত এলাকার চাষি বাবুল হোসেন বলেন, ‘স্থানীয় কয়েকজন কৃষক চায়ের নার্সারি করলে তাদেরকে দেখে গত ১২ বছর আগে চায়ের নার্সারি শুরু করি। শুধু নার্সারি করেই আমি স্বাবলম্বী। আগে আমরা কয়েকজন কৃষক চায়ের নার্সারি করলেও পরে আমাদের গ্রামের সবাই নার্সারি করেন।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, জেলার যেসব এলাকায় চায়ের নার্সারি হয় সেসব এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নার্সারির সংখ্যা বিরাজোত গ্রামে। চায়ের নার্সারি করে মানুষ বেশ উপকৃত হচ্ছেন। ওই গ্রামের নার্সারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে তারা বেশ কয়েকবার কর্মশালা করেছেন। লাভজনক হওয়ায় দিন দিন মানুষ এই ব্যবসায় ঝুঁকছেন।
এসআইএইচ