বস্ত্র প্রকৌশল বিদ্যার আদ্যোপান্ত
বৃহৎ পরিসরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জিডিপিতে অবদান বৃদ্ধি, রপ্তানি খাতকে সমৃদ্ধশালী করা থেকে শুরু করে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসারে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখা খাত হলো তৈরি পোশাক শিল্প। স্বাধীনতার সাত বছরের মধ্যে একদম শূন্য থেকে শুরু করে পোশাক খাত বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে করেছে সমৃদ্ধ। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের তথ্য মতে পোশাক শিল্পের শ্রমিক সংখ্যা ৪০ থেকে ৪৫ লাখ। ইপিবির সবর্শেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এর ফলে চীনের পরেই পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মেইড ইন বাংলাদেশ ট্যাগ যুক্ত লাল সবুজের বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে বস্ত্র শিল্পের ইতিহাস
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘রিয়াজ গার্মেন্টস’। এর কর্ণধার পুরান ঢাকার মৃত রিয়াজ উদ্দিন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রথম ফ্রান্সে ১০ হাজার শার্ট রপ্তানি করে রিয়াজ গার্মেন্টস। মূলত রিয়াজ গার্মেন্টস প্রথম পোশাক রপ্তানি করলেও শতভাগ রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস হিসেবে বাংলাদেশে বিজিএমইএ বরাতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় ‘দেশ গার্মেন্টস’ যা ১৯৮০ সালের দিকে যাত্রা শুরু করে।
বস্ত্র প্রকৌশল বিদ্যা কী
বস্ত্র প্রকৌশল বিদ্যা বা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং আসলে ক্ষুদ্র তন্তু থেকে কাপড় বানানোর উপযোগী সুতা তৈরি করা থেকে শুরু করে বস্ত্র তৈরি নানা ধাপের সমন্বিত রূপ। এর মধ্যে কাপড়ের মান উন্নয়নে কেমিক্যালের নানা ব্যবহার, পোশাক কারখানার শত রকমের মেশিন ব্যবহারসহ আরও অনেক কিছু রয়েছে। আমরা যে পোশাক পরি তা নিয়ে বিভিন্ন রকমের গবেষণা, নতুন ধরনের কাপড় উদ্ভাবন, নিত্য নতুন ধরনের কাপড় তৈরিসহ আরও অনেক কিছুই করেন একজন বস্ত্র প্রকৌশলী।
বস্ত্র প্রকৌশল বিদ্যা কেন পড়ব
দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশ যে শিল্পখাতের দখলে সেই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেলে, কেন নয়? বাংলাদেশে ছোট বড় মিলিয়ে ১০ হাজারের বেশি টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এই সমস্ত ইন্ডাস্ট্রির জন্য এখন পর্যন্ত দেড় লাখের বেশি দক্ষ বস্ত্র প্রকৌশলীর ঘাটতি রয়েছে।
কোথায় পড়ানো হয়
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৭টি সরকারি টেক্সটাইল কলেজ, একটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৮টি ডিপ্লোমা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান, ৪২টি সরকারি টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটসহ বেশ কিছু স্বনামধন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টেক্সটাইল শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
কী পড়ানো হয়
টেক্সটাইলে নন-ডিপার্টমেন্টাল সাবজেক্ট পদার্থ, রসায়ন, ইংরেজি, গণিত, সমাজবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান, ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স, পলিমার সায়েন্স, সিএসসি, ইইই, মেকানিক্যাল ও টেক্সটাইল বেজড্ ডিজাইন অ্যান্ড প্যাটার্ন মেকিং, ইয়ার্ন, ফেব্রিক, অ্যাপারেল, ওয়েট প্রসেসিং এর মতো বিভিন্ন বিষয়গুলো পড়ানো হয়। বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করতে বাংলাদেশে মোটামুটি প্রায় সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ১৬০+ ক্রেডিট এর বিভিন্ন সাবজেক্ট এর সমন্বয়ে গঠিত কোর্স সম্পন্ন করতে হয়।
উচ্চ শিক্ষার সুযোগ
বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করার পর চাইলে দেশে বা বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। উল্লেখযোগ্য বুটেক্স, ডুয়েট, মাভাবিপ্রবি, নিটারসহ অনান্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়াও দেশের বাইরে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, চীন, তুরস্ক, মালেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে টেক্সটাইল বা টেক্সটাইল রিলেটেড বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের বিস্তৃত সুযোগ রয়েছে।
চাকরির ক্ষেত্র
বস্ত্র প্রকৌশলীদের জন্য সরকারি-বেসরকারি দুই ধরনের চাকরি রয়েছে বাংলাদেশে। বেসরকারি বা বাংলাদেশের সব থেকে বড় চাকরির বাজার বস্ত্র খাতে রয়েছে ছোট বড় মিলিয়ে ১০ হাজারের অধিক বস্ত্র কারখানা, যেখানে যোগ্যতা ও পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে, অফিসার, সিনিয়র অফিসার, প্রোডাকশন ম্যানেজার, জিএম, ইডি এর মতো পদে জবের সুযোগ। এ ছাড়াও ফ্যাক্টরিতে কয়েক বছর জবের পর অনেকে বায়িং হাউজে মার্চেন্ডাইজিং এ জয়েনের সুযোগ পান। ডেকাথলন, ইউনিক্লো, এইচঅ্যান্ডএম সহ অনেক স্বনামধন্য বায়িং হাউজ ফ্রেশারদের (সদ্য পাস করা ইঞ্জিনিয়ার) মার্চেন্ডাইজিং এ নিয়োগ করা হয়ে থাকে।
সরকারি চাকরির সুযোগ
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন, বস্ত্র পরিদপ্তর, পাট অধিদপ্তর, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন, বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, সরকারি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সরকারি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটসহ আরও বিভিন্ন সেক্টর।
সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো, বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে অনেক চাকরির সার্কুলারে বর্তমানে উল্লেখ করেই দেওয়া হয় শুধুমাত্র টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকেও চাকরি করা যাবে। বিসিএস নিয়েও যদি কারো স্বপ্ন থাকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারদের জন্যে রয়েছে সেই সুযোগও। দেশীয় ও বিদেশি বিভিন্ন টেক্সটাইল ব্র্যান্ডে একজন টেক্সটাইল ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীরা সর্বাধিক সমাদৃত হবে। মেডিকেল টেক্সটাইল, জিও টেক্সটাইল, স্পেস টেক্সটাইল থেকে শুরু করে নানান রকম সেক্টরেও রয়েছে কাজ করার বিশাল সুযোগ। এত বড় একটি সেক্টরে যুক্ত হবার জন্যে হলেও টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ালেখা করা উচিত।
এসএন