আলোর মানুষ লাইব্রেরিয়ান জসিম উদ্দিন
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার পাইকপাড়া মির্জাপুর গ্রামে জন্ম মো. জসিম উদ্দিনের। তার বাবা মো. আব্দুল মোতালেব শেখ ও মা মোছা. আমেনা খাতুন। বাবা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। তৃতীয় শ্রেণির বই হাতে নিয়েই সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনিই অগ্রজ।
বাবা আর না ফেরায় পুঁথিগত বিদ্যার বা স্কুলের ইতি সেখানেই টানতে হয় জসিম উদ্দিনের। ওই বয়স থেকেই কাঠমিস্ত্রির কাজ শিখতে শুরু করেন। এখনো পেশাগতভাবে তিনি একজন কাঠমিস্ত্রি। কাঠমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেছেন নানা জায়গায়- ঢাকা, চট্টগ্রাম এমনকি ভারতেও। যখন কাঠের কাজ থাকত না তখন অন্য কাজ করতেন। এমনকি রিকশাও চালাতেন।
জীবন ও জীবিকার এই টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েও জসিম উদ্দিন নিজের মতো নিজেকে শিক্ষা দিয়েছেন। অবসর সময়ে নানা ধরনের বই-পত্রিকা পড়তেন, নিজের মতো লেখালেখিও করতেন। নিজেকে বাস্তব শিক্ষা ও স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন বছরের পর বছর ধরে এবং মনে প্রাণে লালন করেছেন অদম্য এক আলোর স্বপ্ন। একটা উন্মুক্ত পাঠাগার বা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন নিজ গ্রামে, যেটা সব শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য উন্মুক্ত।
বলতে গেলে কৈশোরবেলা থেকেই এই স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন জসিম। তিনি নিজেকে যেমন উন্মোচন করেছেন ঠিক তেমনই সবাইকে জ্ঞানের আলোয় উন্মোচিত করতে চেয়েছিলেন। তার এই স্বপ্ন অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর ২০১৫ সালে নিজ মায়ের ভিটার তিন শতাংশ জায়গার এক শতাংশের উপরে নির্মাণ করেন টিনের ছাউনি ও কংক্রিটের মেঝে দিয়েই শুরু 'খোসকা কমিউনিটি লাইব্রেরি'।
বর্তমানে লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৫০০ এর বেশি। পাঠক সংখ্যা প্রায় ৪৭০ জন। নিয়মিত পাঠক সংখ্যা দুইশ'র বেশি। জসিম উদ্দিন যে শুধুমাত্র বই পুস্তক নিয়ে কাজ করছেন তা নয়। তিনি কোমলমতি নতুন প্রজন্মদের নানাভাবে বিভিন্ন উপায়ে বৈশ্বিক জ্ঞান চর্চা, গান বাজনা, লেখালেখি, প্রযুক্তি ও তার স্বপ্নের মতোই গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন, যেমনটা তিনি তার আপন কৈশোর বেলায় পাননি। তাদের শুধুমাত্র স্কুলের পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে উন্মুক্ত জ্ঞান চর্চার দিকে তিনি নিরলসভাবে উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন।
জসিম উদ্দিনের স্বপ্ন, তিনি এখানে একটি আধুনিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে চান। যেখানে বাংলা ভাষায় বৈশ্বিক জ্ঞান চর্চার এক ভান্ডার থাকবে, সব ধরনের বই থাকবে এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব ধরনের অগ্রযাত্রায় পদচারণা করতে চান ও অংশগ্রহণ করতে চান তিনি। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে বসবাস করে এমন ভাবনা ভাবা এবং তাকে স্বপ্ন করে সেটার বাস্তবায়ন করা সত্যিই বিরল।
তিনি গ্রাম্য পরিস্থিতি নিয়ে জানান, গ্রামের অনেকেই বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে তিনি প্রযুক্তির যুগে প্রযুক্তির সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা ও পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি কম্পিউটার, ডিভাইস ও সফটওয়্যার বিষয়ক বই নিয়ে কথা বলেন। তার ইচ্ছা, অন্তত কিছু কম্পিউটার থাকবে তার পাঠাগারে, যেখান থেকে শিক্ষার্থী ও পাঠকরা কম্পিউটারের প্রাথমিক খুঁটিনাটি ধারণা পাবেন। এমনটাই স্বপ্ন তার। একটা আধুনিক পাঠাগার যেখানে সব ধরনের বই থাকবে, প্রযুক্তি থাকবে এবং সবার জন্য তা উন্মুক্ত থাকবে।
জসিম উদ্দিনের মায়ের ভিটায় দুটি টিনের ঘর, একটিতে তিনি ও তার পরিবার বসবাস করে এবং অন্যটি পাঠাগার। নিজের পরিবার ও জীবন-জীবিকার কথা তুলতেই তিনি বলেন, সমস্যা সবারই থাকে, হোক সেটা আর্থিক সমস্যা অথবা জাগতিক, কিন্তু মানুষের উচিৎ তার স্বপ্নে অবিচল থাকা।
কথা প্রসঙ্গে তিনি নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বিখ্যাত উক্তিটি আওড়ান, 'তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব।'
জসিম উদ্দিনের দর্শন ও চিন্তাভাবনা দূরদৃষ্টি ও দূরদর্শী, যেটা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নতুন আলোর মুখ দেখাবে এই কামনা করি। তিনি এখনো কাঠমিস্ত্রি হিসেবেই জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতি শুক্রবার ছুটি থাকে, সেদিন তিনি নানারকম উদ্বুদ্ধমূলক কাজ করেন পাঠাগারে। গানের প্রতিযোগিতা, ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা এবং পাঠ্যপুস্তক সম্বন্ধীয় সব ধরনের রুচিশীল ও মানসম্মত আয়োজন করে থাকেন। তিনি জানান, এতে তিনি তৃপ্তি বোধ করেন এবং নতুন এক শিক্ষিত আলোকিত প্রজন্মের স্বপ্ন দেখেন।
লাইব্রেরিয়ান মো. জসিম উদ্দিনের এখনকার স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা সুগঠিত আধুনিক এবং নিজ জমির উপর সুন্দর করে সম্পূর্ণ কংক্রিটের লাইব্রেরি তৈরি করতে চান। সরকারি-বেসরকারিভাবে সামান্য অনুদান পেলেও তিনি তার স্বপ্নকে আরও সামনে এগিয়ে নিতে সবার সুদৃষ্টি ও শুভকামনার প্রত্যাশা করেন।
তার স্বরচিত পাঠাগার নিয়ে লেখা কবিতাটি হলো-
পাঠাগার
মো. জসিম উদ্দীন
পাড়া-মহল্লায় প্রতি বাড়ি-ঘরে পাঠাগার গড়তে চাই,
বিশ্বমানব আলোকিত জীবনে যার বিকল্প নাই!
পাঠাগারেই এনেছে সভ্যতা আজ অসভ্য করেছে দূর,
দুর্ভাগ্য আজ পাঠাগার ছাড়া তুলছি ভিন্ন সুর!
রাষ্ট্রীয়-পারিবারিক উৎসবে যেন বই'ই হবে উপহার,
ভুরিভোজ খেয়ে নগদ অর্থ কাম্য না অলংকার!
বই রাখব প্রতি রুমে র্যাকে রাখব হাতের কাছে,
আলসে নয় জ্ঞানাস্বাদনে রইব নাতো পড়ে পাছে।
কবি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, প্লেটো, মাইকেল মধুসূদন দত্ত,
মহামানব মনীষীর বাণী করব আমরা রপ্ত।
কেউই মরেনি এসেছে তারা আমাদের যাচ্ছে ডেকে,
এসো নবীন দল জ্ঞানচর্চা করি পাঠাগারের ওই র্যাকে।
এসেছে গুণী কবি বিজ্ঞানী জ্ঞান সাগরে জাহাজ বেয়ে,
নোঙর করেছে পাঠাগার মাঝে আমরা উঠব যেয়ে।
এসজি