ধুঁকে ধুঁকে চলছে কামার পল্লি
লোহা পেটানোর শব্দ ছড়িয় পড়ত এলাকাজুড়ে। সমানতালে চলত হাপরের ওঠা-নামা। কিন্তু জয়পুরহাটে কামারদের ব্যস্ততা এখন শুধু স্মৃতি। অলস বসে হতাশায় দিন কাটছে কামারদের।
১৬ বছর ধরে শহরের জামালগঞ্জ রোড়ের বাবু টিনের দোকানের পাশে টিনের ছাউনিতে কাজ করতেন প্রতীপ কর্মকার। কিন্তু সেই জায়গার মালিক বাচ্চু মিয়া বড় দালান তৈরি করবে বলে প্রতীপ কর্মকারকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে। এখন তিনি শহরের মহিলা কলেজের পাশের গলির মধ্যে বিহারী পাড়ায় কাজের সরঞ্জাম নিয়ে হতাশ হয়ে বসে আছেন।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কামাররা কেউ সামান্য কাজ করছেন আবার কেউবা রয়েছেন বসে। কাজের অভাবে অলসতায় কাটছে তাদের দিন। জায়গা ও কয়লার অভাবে ভুগছে এই পেশার লোকজন। আগে গরাণ, সুন্দরী, বাবলা, বাইন কাঠের কয়লা পাওয়া যেত। এখন পাওয়া যায় মেহগনি, আম, সিরিজ কাঠের কয়লা। এই কয়লা পরিমাণে লাগে বেশি। কয়লা ভালো না হলে লোহা তাড়াতাড়ি গরম হয় না। ফলে একটা জিনিস তৈরি করতে সময়ও লাগে অনেক। তাই এই কামারশালায় কর্মব্যস্ততা কমছে দিন দিন। কয়লা সংকট, ক্রেতার অভাবসহ নানা সমস্যায় ধুঁকে ধুঁকে চলছে কামারশালা। চাষিরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বিদেশি প্রযুক্তির উপর। দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি কামার শিল্পের চাহিদাও দিন দিন কমছে। দেশের ঐতিহ্য বহন করে এই কামার শিল্প। কামারশালা টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহযোগিতা কামনা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পারুলিয়া মহল্লার প্রতীপ কর্মকার বলেন, ‘সকাল থেকে বসে আছি কোনো কাজ করতে পারিনি। নতুন এই জায়গা ভাড়া নিয়েছি প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা দিতে হবে। আবার বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় ৪০০ টাকা। ফলে এ কাজ করে এখন সংসার চালানো বড় কঠিন। বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ চালাতে খুব কষ্ট হয়। এখন কৃষি যন্ত্রপাতি থেকে রাজমিস্ত্রির সরঞ্জাম তৈরি করা হয় বেশি। তবে কয়লা সমস্যার কারণে এখন ঠিকমতো কাজ করতে পারি না। এখন কয়লাগুলো শহরের বিভিন্ন হোটেল থেকে প্রতি বস্তা ৫০০ টাকায় কিনি। আগে এক বস্তা কয়লায় দুই দিন চলতো কিন্তু এখন যায় এক মাস। কাজের অবস্থা খুবই খারাপ।’
শহরের কুন্ডুপাড়া সোনার পট্টি মহল্লার শ্রী সুদিপ কর্মকার বলেন, ‘কামার শিল্পের বর্তমান অবস্থা খুব ভয়াবহ। প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পেশায় নিয়োজিত আছি। বাপ-দাদার পেশা। লাভ না হলেও ধরে রেখেছি। ছোটবেলা থেকে আমি বাবার সঙ্গে কাজ করতাম। এমন কোনো দিন ছিল না যে বাবা চারটি লাঙল আর ১০টি কাঁচি বানাত না। একটি নিন্মবিত্ত পরিবার থেকে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত সবার ঘরে ঘরে রয়েছে এই কামার শিল্পের যন্ত্রপাতি। এই কাজে কমপক্ষে দুইজন লোক লাগে। কিন্তু বর্তমানে এই পেশায় কেউ আসে না। তাই নিজের ছেলেকে নিয়ে কাজ করি। আগে চাষাবাদ হতো। তাই লাঙলের ব্যবহার ছিল। লাঙল তৈরির কাজও করতাম। আগে আউশ চাষে নিংড়ানি, পাশনি, আচড়া ব্যবহার হতো। কিন্তু এখন চাষ কমে যাওয়ায় লাঙলসহ এসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমেছে। মানুষ বিদেশি প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে ৩০০ টাকা পাই। এই টাকা দিয়ে ৬ জন সদস্যের পরিবার চালানো দুস্কর। ছোট ছেলে জয়পুরহাট সরকারি কলেজে পড়ে। অর্থের অভাবে তাকে ভালো প্রাইভেট দিতে পারি না। এর মধ্যে যে জায়গায় কাজ করতাম সেই জায়গাটাও নেই। সংসারের লোকদের নিয়ে বিপদে আছি।’
কুমার পাড়ার সন্তোশ মহন্দ বলেন, ‘আমি ও আমার ভাই এখানে একসঙ্গে কাজ করি। কামকাজ কোনোমতে চলছিল বর্তামানে তাও নেই। আমরা এখানকার স্থানীয় লোক। অভাবের সংসারের কারণে লেখাপড়া শিখতে পারিনি। আমার বয়স যখন ১৪ বছর তখন থেকে কামারের কাজ করি। এ কাজে লোহা সবসময় পাওয়া যায় কিন্তু কয়লা সব সময় পাওয়া যায় না। আগে এক বস্তা কয়লা ৫০ টাকায় কিনতাম কিন্তু এখন এক বস্তা কয়লার দাম ৪০০ টাকা। কয়লা ভালো না হলে লোহা পোড়ে না। বাজে কাঠের কয়লা দিয়ে কাজ ভালো করা যায় না।’
সোনার পট্টি বাসিন্দা সুব্রত কর্মকার বলেন, ‘আমি পঞ্চম শ্রেণি থেকে বাবার দোকানে কাজ করি। অভাবের সংসার তাই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরেছি। পরিবারের ৬ জন সদস্য নিয়ে চিন্তায় আছি। আগে মোটামুটি ভালোই কাজ হতো। যা দিয়ে কোনো রকম সংসার খরচ চলত কিন্তু বর্তমানে বসে বসে দিন গুণতেছি কাজ নেই খাব কীভাবে?”
জয়পুরহাট জেলার সচেতন নাগরিক সমাজের কৃষিবিদ ওবায়দুল্লাহ মুসা বলেন, এ জেলায় কামার শিল্প চলছে ধুঁকে ধুঁকে। জায়গা পরিবর্তন আর চাষাবাদ কমে যাওয়ার কারণে কামারদের তেমন কাজ নেই। এর মধ্যে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির কারণে মহাসংকটে আছে কামারপল্লি। দেশের ঐতিহ্য বহনকারী এই কামার শিল্প সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
এসএন