খেয়াঘাটে আজও বসে থাকেন সালাম
নিয়তির সঙ্গে তার কোনো শত্রুতা ছিল না। ছিল না কারোর সঙ্গেই। তারপরেও কেন এত নিষ্ঠুরতা? জন্ম থেকেই বিকলাঙ্গ। তা নিয়েও কোনো ক্ষোভ ছিল না তার। অস্বাভাবিকতাকেই স্বাভাবিক মেনে নিয়েছেলেন তিনি। নিয়তিকে বিদ্রুপ করে তিনি দেখিয়েও দিয়েছিলেন শূন্যতার মাঝেই আছে পূর্ণতা। না, তারপরেও নিয়তির নিষ্ঠুরতা পিছু ছাড়েনি তার।
বরগুনা সদর উপজেলার নিশান বাড়িয়া গ্রামের আব্দুস সালাম। ছোট দুই শিশুপুত্র আর স্ত্রী পরিবানুর মাঝেই তার স্বর্গ। দিনভর ভিক্ষে করে যে দু'পয়সা রোজগার, তা দিয়েই কখনো বিস্কুট কখনো চকলেট আবার কখনোবা ট্রলার মালিকদের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে ছোট্ট একটি ইলিশ নিয়ে হামাগুড়ি দিয়েই তার বাড়ি ফেরা। বাবাকে ঘিরে সন্ধ্যে বেলা অবুঝ দুই শিশুর মধুর খুনসুটি সালামের সব না পাওয়ার বেদনা ঘুচিয়ে দেয় নিমিষেই। সালামের বাবা-মায়ের মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। তাই স্ত্রী পরি আর বৃদ্ধ শাশুড়ির জন্য ছিল তার অকৃত্রিম ভালোবাসা।
বিষখালী নদীর ঠিক ওপারে পাথরঘাটার বাজার। বাবার সঙ্গে ওই বাজারে যাওয়ার নিত্য বায়না ছিল ছেলেদের। বায়না মেটাতে প্রায়ই সালাম তার দুই ছেলেকে নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে। পাথরঘাটা নিশানবাড়িয়া খেয়াঘাটের এক কোনে শারীরিক প্রতিবন্ধী বাবা সবার সহানুভূতি আকর্ষণে ব্যস্ত, অদূরেই খেলায় মগ্ন দুই শিশুপুত্র রুবেল আর ইব্রাহীম। ইব্রাহীম বড়। ছোট ছেলে রুবেল
পাথরঘাটার বাজার থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফেরে সালাম। তাই বিকেল হলেই বাবার পথ চেয়ে উঁকিঝুকি মারতে থাকে শিশু রুবেল আর ইব্রাহীম।
এরই মধ্যে এক অন্ধকার রাতে হঠাৎ এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাদের। শারীরিক প্রতিবন্ধী অসহায় বাবার চোখের সামনে দিয়ে এক এক করে কেড়ে নেয় তার সোনার টুকরো ফুটফুটে দুই শিশু রুবেল আর ইব্রাহীমকে। ভয়ংকর তুফানের তোড়ে ভেসে যায় ছোট্ট দুই অবুঝ শিশু। আজও কানে ভাসে, ‘বাপ আমারে ধর, আমাগো বাঁচাও, আমাগো তো ভাসাইয়া লইয়া গেল, ধর বাপ আমাগো।'
শিশু রুবেল আর ইব্রাহীমের সেদিনের সে চিৎকার যেন পাথরঘাটা আর নিশান বাড়িয়ার আকাশে বাতাসে আজও ভেসে বেড়ায়। নিষ্ঠুর বিধাতাকে সেদিন জনমের মতো গাল দিয়েছিলেন সালাম। পা দুটো তার ভালো থাকলে হয়ত সেদিন আদরের ছেলে দুটোকে সে বাঁচাতে পারত। সেদিন ছেলেদের বাঁচাতে ভয়ংকর তুফানের মাঝেই নিজেকে সমর্পণ করেছিল সালাম। তারপরের কথা আর তার মনে নেই। যখন হুশ ফির এল তখন চারিদিকে তার খাঁ খাঁ শূন্যতা।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ১৫ বছর পার হয়ে গেল। হাত-পা অকেজো তারপরেও কী করে বেঁচে থাকলেন প্রতিবন্ধী সালাম বিস্মিত স্থানীয়রা।
নিশান বাড়িয়ার খেয়াঘাটে আজও নির্বাক বসে থাকেন সালাম। সব কিছু কেড়ে নিয়েও নিষ্ঠুর বিধাতা তাকে কেন বাঁচিয়ে রাখলেন এ প্রশ্নের উত্তর পান না তিনি। সালাম বলেন, 'আল্লাহ আমার সব কেড়ে নিয়ে আমারে ক্যান বাঁচিয়ে রাখল। সবাই সব নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। আমি কী নিয়ে ঘুরে দাঁড়াব?'
এসএন