পুতুল নাচ বন্ধ হওয়ায় চরম দুর্দিন যাচ্ছে শিল্পীদের
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচ বন্ধ হয়ে যাওয়া কুড়িগ্রামের মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার শিল্পীদের চরম হতাশায় দিন কাটছে। চরম দুর্দিন থাকার পরেও স্থানীয়ভাবে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে মেলে না সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা।
এক সময় গ্রামগঞ্জ, হাট-বাজার, স্কুল কিংবা খোলা মাঠে মঞ্চ সাজিয়ে যে পুতুল নাচের আসর জমতো এখন আর সেই দৃশ্য চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ এখন স্বপ্নের স্মারক। শুধু পুতুল নাচ-ই বিলুপ্তি হয়নি, পুতুল নাচ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট শিল্পীরাও পড়েছেন চরম বিপাকে। দীর্ঘ সময়ের পেশাকে আগলে রেখে জীবিকা নির্বাহ করা শিল্পীরা অর্থের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এক সময়ে পুতুল নাচ দেখিয়ে আনন্দ দেওয়া মানুষের দুঃখ কষ্টে দিন কাটলেও খোঁজ রাখে না কেউ।
উত্তরবঙ্গের মধ্যে লাইসেন্সপ্রাপ্ত একমাত্র কুড়িগ্রাম মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার। জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা পাথরডুবি ইউনিয়নের দক্ষিণ পাথর ডুবি গ্রামের এই সংগঠন। মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটারের মালিক-মকবুল হোসেন, সভাপতি ভানু চন্দ্র বর্মন, সদস্য আবুল হোসেন, প্রফুল্ল চন্দ্র বর্মন, হোসেন আলী, মোজাম্মেল হক, শ্রী স্বপন বর্মন। এ ছাড়াও মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটারের ম্যানেজার আব্দুর রহিম ২০২০ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে মারা যান। এই সংগঠনের সরকারি তালিকাভুক্ত শিল্পী মকবুল হোসেন ও আবুল হোসেন। মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকা হারে বছরে ১৮ হাজার টাকা পান তারা।
মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার মকবুল হোসেন প্যারালাইজড হয়ে প্রায় ৩ বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন। সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামে দুই স্ত্রী, ৫ ছেলে এবং ৬ মেয়ে নিয়ে তার সংসার। সহায় সম্পদ বলতে বাড়িভিটা-২০ শতক। ছেলেরা কৃষি কাজ করেই সংসার চালাচ্ছে।
তিনি জানান, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার ‘মা কালি পুতুল নাচ’ সংগঠনের মুরালী বর্মণের কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকায় কিনে নেন দক্ষিণ পাথর ডুবি গ্রামের বাসিন্দা মকবুল হোসেন। এরপর ১৯৮৪ সালে সেই নাম বদলে রাখা হয় মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার। ভারতের কোলকাতা, কোচবিহার শিলিগুঁড়ি থেকে পুতুল নাচের মাস্টার এনে প্রায় ৬ মাসের প্রশিক্ষণ নেন বাংলাদেশের ৯ জন শিল্পী।
প্রথমে কুড়িগ্রামে পুতুল নাচ দেখালেও ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নিবন্ধন পাওয়ার পর ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গে পুতুল নাচ দেখান তারা। এক ফুল দুই মালি, কাশেম মালার প্রেম, সতী রূপভান, রাম বনবাস, দানবীর রাজা হরিশ চন্দ্র, রাবন বধ, মহাসতী সাবিত্রী সত্যবান, সাগর ভাষাসহ ২১টি পালা নিয়ে মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার পালা ছিল। শিল্পকলা থেকে পুরস্কার পেলেও যোগাযোগ আর অর্থাভাবে মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার দল বিদেশে শো করতে পারেনি। সময়ের ব্যবধানে যাত্রাপালার সঙ্গে পুতুল নাচ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আগের মতো তাদের ডাক আসে না। প্রায় ২০ বছর ধরে তারা পুতুল নাচ দেখাতে না পেরে আয় রোজগারও নেই সংগঠনের শিল্পীদের। দিনমজুরি করে সংসার চলছে এসব শিল্পীর। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ৯ সদস্যের মধ্যে একজন মারা গেছেন আর একজন অসুস্থ। সংগঠনের বাকি ৭ সদস্যের মধ্যে দুইজনের শিল্পী ভাতা পাচ্ছে। আর অন্যরা এখনো সেই ভাতার অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ ছাড়াও সীমান্ত আর প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তাদের খোঁজ-খবর রাখে না। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাড়াইটারী গ্রামের বাসিন্দা মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটারের সভাপতি শ্রী ভানু বর্মণ। অসুস্থ শরীর নিয়ে তারই আয়ে চলে স্ত্রী আর মেয়েসহ ৫ জনের সংসার। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম তিনিই। বাড়িভিটা ৬ শতক ছাড়া আর কোনো অর্থ-সম্পদ নেই ভানু বর্মণের।
তিনি বলেন, ১৯৮৪ সাল থেকে এই দলে কাজ করছি। প্রায় ২১টি যাত্রাপালায় সুরের তালে তালে পুরুষ-মেয়ে কণ্ঠ দেই। আগে পুতুল নাচ দেখিয়ে প্রতি শো-তে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা আয় হতো। তাই দিয়ে স্বচ্ছলভাবে চলেছিল সংসার। কিন্তু গত ২০-২২ বছর থেকে পুতুল নাচ বন্ধ থাকায় অভাব আর অর্ধাহারে পরিবার নিয়ে দিন কাটে তার। মাঝে মধ্যে হঠাৎ সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে পুতুল নাচের খেলা দেখালে তাই দিয়ে চলে অভাবে সংসার।
পালাকার আবুল হোসেন বলেন, পুতুল নাচ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সরকারিভাবে দুয়েকটি অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে। এতে করে ৩/৪ শো টাকা পাওয়া যায়। আর সারা বছর দিনমজুরি করেই সংসার চলে।
তবলা বাদক স্বপন বর্মণ বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে এই পুতুল নাচের সঙ্গে জড়িত। প্রযুক্তি ও আধুনিক যুগে এসে মানুষ আর পুতুল নাচ দেখে না। ফলে শো না থাকায় আয়ও কমে গেছে। সরকারিভাবে কোনো ভাতা জোটেও না এবং স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানরাও কোনো খোঁজ রাখে না। ভিজিডি, ভিজিএফসহ সরকারের অনেক সুযোগ সুবিধা থাকলেও তারা আমাদের দেয় না। এতে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে।
ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার সাহেবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রোজন চন্দ্র বলেন, প্রায় ২০ বছর পর পুতুল নাচ দেখতে পেলাম ঘরোয়াভাবে। আগে পুতুল নাচ দেখতে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দলবলে বাংলাদেশে এসে টিকিট কেটে পুতুল নাচ দেখতাম।
বাংলাদেশি সোহেল রানা জানান, যাত্রাপালার অশ্লীলতায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচও এখন বন্ধ। ক্ষণিকের জন্য পুতুল নাচ দেখতে পেয়ে ৩০/৩৫ বছর আগের শৈশবের কথা মনে পড়ে যায় তার। আগে ১/২ টাকায় টিকিট কিনে পুতুল নাচ দেখেছেন। ঐতিহ্যবাহী এই পুতুল নাচ টিকিয়ে রাখতে সরকারে কাছে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এ প্রসেঙ্গ কুড়িগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ রাশেদুজ্জামান বাবু জানান, উত্তরবঙ্গের একমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত মনিকা পুতুল নাচ অ্যান্ড থিয়েটার দলের দুজন সরকারিভাবে ভাতা পাচ্ছেন। বাকিদের পর্যায়ক্রমে ভাতার আওতায় নিয়ে আসা হবে। পুতুল নাচ টিকিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি দাতা সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
এসএন