স্বাধীনতাবিরোধীদের হুংকার ও সমাবেশের সহোদর
তানজিব রহমান
‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায়?’ কবি রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়’র এ পঙতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে স্বাধীনতা সঙ্গীত বা মুক্তির গান বলা চলে। কবির দুটি চরণ থেকেই আমরা স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝতে পারি। পৃথিবীর কোন জাতি পরাধীন থাকতে চায় না।
স্বাধীনতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। স্বাধীনতা এবং মুক্তির আকাঙ্খা যুগে যুগে মানুষের মনে ছিল। স্বাধীনতার স্বপ্ন ও মুক্তির চেতনা তাদের মনকে আন্দোলিত করেছিল যুগ, যুগান্তর। কখনো ফরাসি বিপ্লব, কখনো রেঁনেসা, কখনো আবার শিল্পবিপ্লব হয়ে তা আমাদের সামনে উঠে এসেছে। তবে এগুলোর সব কিছুর মূলেই কিন্তু স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস পরিণতি ও পরিসমাপ্তি আছে।
পৃথিবীর অনেক জাতি আছে যাদের স্বাধীনতার ইতিহাস আমাদের মতো এতোটা গৌরব দীপ্ত নয়। তারা একই সাথে স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য ঝাপিয়ে পড়েনি আমাদের মুক্তির ইতিহাসটা পলাশী থেকে ধানমন্ডি ৩২ পর্যন্ত বিস্তৃত যা এখনও আমরা করে যাচ্ছি। আমাদের স্বাধীনতার একজন মহানায়ক আছেন-যার তর্জনীর ইশারায়, বজ্রকন্ঠের ডাকে সমগ্র বাঙালি জাতি সেদিন জেগে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আর তাতেই সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতার মুখবন্ধ রচিত হয়ে গেল।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়ে গেলাম একটা স্বাধীন ভূ-খন্ড সার্বভৌম দেশ। আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্তরাধিকার ও রাজাকার দোসরদের বিরুদ্ধে এ সংগ্রাম নিরন্তর করে যেতেই হবে। তবে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কিন্তু তখন থেকে এখনও তাদের দোসরদের কাঁধে ভর করে রাজনৈতিক শক্তিতে আবির্ভূত হচ্ছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে বিএনপির জনসভায় স্বাধীনতাবিরোধী বিতর্কিত নেতা সা.কা. চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এই আওয়ামী লীগ সরকারকে বলে দিতে চাই, ক্ষমতা ছাড়ার পর একা বাড়িতে যেতে পারবেন না। প্রত্যেকটা শহীদের বাড়িতে গিয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করব।’
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে হুম্মাম বলেন, ‘যাওয়ার আগে বাবার স্লোগান আপনাদের বলে যেতে চাই। নারায়ে তকবির, নারায়ে তকবির, নারায়ে তকবির। আমরা যখন আবার এই ময়দানে আসব, সরকার গঠন করে আসব।’
একজন যুদ্ধাপরাধী রাজাকার পুত্রের এমন হুংকার, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত অবমাননা, একটা রাজনৈতিক দলের ব্যানারে! কী প্রমাণ করে? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের অর্জনকে তারা শুধু বৃদ্ধাঙ্গুলিই দেখাননি, বরং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় এলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির লোকদেরকে একা ঘরে না ফেরার হুমকি দিচ্ছেন প্রকাশ্যে।
বাস্তবে কী হবে তা আমরা তো তাদের পেট্রোল বোমা ও আগুন সন্ত্রাসী দিনগুলোর সময় দেখেছি।এই কালকেউটেদের ফনা বাংলাদেশকে আরো গুরুত্বের সাথে আমলে নেয়ার সময় এসেছে। এদের ফুঁস করে উঠতে দেয়া যাবে কি-না তা বাংলাদেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নিবে যেমনটা নিয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে।
অসাম্প্রদায়িক, শান্তি ও সৌহার্দ্যের বাংলাদেশ, মিলে-মিশে বাংলাদেশ, সবার জন্য বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশের জন্য এরা অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অতীতেও তার দাদা ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছয়দফার বিরোধী ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধী ছিলেন, ১৯৭১ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রায় দেড় মণ সোনা নিয়ে নৌ-যানে করে দেশ থেকে পালানোর সময় আনোয়ারা উপজেলার গহীরা উপকূলে মুক্তিযুদ্ধাদের হাতে ধরা পরেন।
এসব অপশক্তির মূল কত গভীরে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাদের মূল উৎপাটনে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজাকার সাকা পুত্রের বক্তব্যে কপালে ভাঁজ ফেলার মতো আরো একটি বিষয় হলো-তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে অবমাননা করে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির সাজা হওয়া সব আসামীদেরকে ‘শহীদ’ বলে জনসম্মুখে বক্তব্য প্রদান করেছেন। তা দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবমাননার শামিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন ১৯৭৩’র ক্ষমতা বলে অপরাধীদের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত যেখানে তাদের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন, সেখানে অপরাধীদেরকে জনসম্মুখে শহীদ বলে আখ্যায়িত করে সর্বোচ্চ আদালত অবমাননা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত। রাষ্ট্রদ্রোহীতার শামিল।
অথচ হুম্মাম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, হুম্মামের এই বক্তব্যকে আমীর খসরু মাহমুদ বিএনপি’র নয়, হুম্মামের ব্যক্তিগত বলে উল্লেখ করেছেন। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা ছাড়া আর কিছু নয়। ২০১৫ সালে যুদ্ধাপরাধে জড়িত সাকা চৌধুরীর রায় কার্যকর হলে বিএনপি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেনি বরং ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দলের কংগ্রেসে সাকা চৌধুরীর নামে শোক প্রস্তাব করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকে তারা এভাবে লালন করেন!
যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা কম, বেশী বিচলিত। ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় দলনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ যুদ্ধাপরাধী নয়, রাজবন্দী। আর আওয়ামী লীগ স্বাধীনতাবিরোধী। দলের চেয়ারপারসনের এ বক্তব্য আজ ও আগামী দিনের বাংলাদেশ কিভাবে নিবে? সবকিছুকে রাজনীতি আর ক্ষমতার মোড়কে ভাঁজ করে রাখলে দেশটাকে এগিয়ে নেবে কে? শুধু ভোটের রাজনীতির জন্য মাতৃতুল্য স্বদেশ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা বিকিয়ে দিয়ে; জনগণের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারলে জনগণের কাছে কী প্রত্যাশা করা যায়?
ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের ফলে চলমান বিশ্বসংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে দেশকে আগামীর জন্য স্থিতিশীল রাখা এবং উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে ভিশনারি নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। একইভাবে আমাদের ভুলে গেলেও চলবে না লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকদের উত্তরসূরীরা এখনো প্রতিশোধের উন্মত্ততায় মরণ কামড় দিতে সুযোগ খুঁজছে। করছে রাষ্ট্রবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র। তাদের হাত থেকে দেশকে ও দেশের স্বাধীনতার মর্যাদাকে বাঁচাতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবেই। তার কোনো বিকল্প নাই।
মেইল : tanzib1971@gmail.com.
লেখক-গবেষক।
ছবি : পাহাড়পুর মহাবিহার।
ওএফএস।