‘লীলাবতী’র শারমিন
হাতের কাজ আছে তার পোশাকের ভুবনে। তিনি আবার চারুকলার ছাত্রী। এমন একজনই হন। শারমিন সুলতানা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টিং, ওরিয়েন্টাল আর্ট অ্যান্ড প্রিন্ট মেকিং বিভাগে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীকে নিয়ে লেখেছেন আসাদুল্লাহ গালিব।
হাতের কাজ জানলে আর চারুকলায় পড়লে সোনায় সোহাগা। ঠিক তেমনই একজন শারমিন সুলতানা। পড়েন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। চারুকলা অনুষদে। প্রিন্টিং, ওরিয়েন্টাল আর্ট অ্যান্ড প্রিন্ট মেকিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষে। চিত্রশিল্পী হবেন বলে এসেছেন মানিকগঞ্জ থেকে মেধায় লড়ে। শিবালয় উপজেলার দারুণ ছাত্রী। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে কভিড ১৯ রোগে যখন স্থবির বিশ্ব, তখন কাজে নামলেন হাতে, হাতে তরুণ চিত্রকর।
শারমিন দারুণ উদ্যমী। বসে না থেকে সময়টিকে কাজে লাগতে চাইলেন। ভেবে বের করলেন, ‘দেশজ পণ্যগুলো নিয়ে কাজ করবো আমি।’ তবে গ্রামের গরীব নারীদের মতো হাতের কাজ করবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী-মানতে পারলেন না অনেকেই। আশ, পাশ থেকে ভেসে এলো কটু বাক্য, বিরক্ত জন্মালো মনে। তবে বাবা, মা, ভাই, বোন অনেক যত্নে গড়েছেন এই আর্টিস্টকে। ফলে তাদের সহযোগিতার কোনো কমতি নেই।
আগ্রহ তার ভীষণ, পারেনও নতুন সবকিছু। ছবি আঁকতে পারেন খুব ভালো, ফলে কীভাবে দেশের উপহার হয়, দশের ভালো হয়, পণ্যটি হয় সবার সেই কাজে লেগে গেলেন শারমিন। লাভ নয়, লোভ নয়, তার আছে কেবলই নান্দনিকতা ও সমৃদ্ধির সোপান। কাজ হলো শুরু শাড়িতে। এরপর পাঞ্জাবির ভুবনে। তাঁতের শাড়ি, খাদিতে আছে জড়িয়ে শারমিনের ভুবন। নিজের হাতে নকশা করেছেন। আশপাশ থেকে সেলাই। গল্পের ডালা মেলেছে তখন। নিত্য, নতুন ভুবন হলো নারীদের জানা। পাটের ব্যাগ, তার ওপর নিজের হাতে ছবি। এরপর কোথাও, কোথাও সেলাই-এই হলো শারমিনের বাংলাদেশী পণ্যের দেশীয় উপস্থাপন।
শিল্পী মন তার। ফলে ছোট থেকেই দেশের ও গ্রামের মানুষের ভালো চেয়েছেন। তাদের উপকারে লাগবে, দারুণ হতে সবার জন্য সবখানে। এই তার কাজের নমুনা। অনেক আগে থেকে ছবি আঁকতে গিয়ে দেশীয় অবহেলিত পণ্যগুলোকে উপযোগিতা দেবার ইচ্ছে তার মনে মনে। আস্তে, আস্তে বড় হলেন। বাড়তে থাকলো যোগ্যতা ও আগ্রহ। নাইন থেকে টেন, মেলাতে গেল মেয়ে। বাবার হাত ধরে ঘুরে, ঘুরে কেনা হলো বাঁশের বাশি, তালের পাখা, মাটির পুতুল আরও কত কী। তারপর জমালেন নিজের কালেকশনে জামদানী, তাঁতের শাড়ি। সেগুলো তার ভাবনা ও জগতকে আরো প্রসারিত করে দিলো দারুণভাবে।
এখন শারমিন সুলতানা একটি ফেসবুক পেইজের মালিক। নাম হলো ‘লীলাবতী’। হুমায়ূন আহমেদের নায়িকা ‘লীলাবতী’র নামে নাম। ভারতীয় গণিতবিদ দ্বিতীয় ভাষ্করের স্ত্রী ‘লীলাবতী’ নামে রাখা স্বামীর বইয়ের নাম, তুমুল বিখ্যাত প্রাচীনকাল থেকে। এই পেইজে খুব সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন ০১৯০২-৫১৫৮১৫ নম্বরে ফোন করে। তাতে আপনাকে স্বাগত।
এখান থেকেই বুটিক হাউজ গড়ে তুলবেন চারুকলার ছাত্রীটি। আশপাশের, দূরের, কাছের মানুষের ভুবনগুলো বদলে দেবেন। ‘আমাদের দেশের পণ্যাদিকে আরো পরিচিত, সমৃদ্ধ এবং প্রচারই আমার লক্ষ্য। সঙ্গে লাভ, লোকসানের হিসেব তো আছেই। আগামী কিন্তু অসাধারণ।’ ছাত্রী বলে, ছাত্র, ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাদের পরিবারগুলোই এখন তার ক্রেতা। বেশিরভাগই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের, অনেকে আছেন মানিকগঞ্জের। রাজেট তাদের কম। ফলে কম বাজেটে ভালো মানের পণ্যে তার আপোষ নেই অন্যসবের মতো। এক লহমায় বলে দিলেন লীলাবতীর মালিক শারমিন সুলতানা, ‘আমার যেকোনো পণ্য কিনতে পারবেন মোটে সাড়ে চারশ থেকে সাড়ে আটশ টাকায়।’
তার একজন ক্রেতা। পেলেন তিনি ‘লীলাবতী’কে। ভালো লাগলো খুব। হাতের কাজের একটি তাঁতের পাঞ্জাবি কিনেছেন। রেজওয়ান বলেছেন খুব খুশিতে, ‘আমি প্রথম একজন চিত্রকরের আঁকা খদ্দরের পাঞ্জাবি কিনলাম। খুব ভালো লাগছে পরতে ও দেখতে। অনলাইন তো আমাদের দূরের, হাতের কাছেই কত দোকান। তবে শারমিনের জবাব নেই। পাঞ্জাবিতে তার কাজের মান অত্যন্ত উন্নত, দামেও খুব কম।’
এমন মেয়েটিকে নিয়ে খুব গর্ব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষকদের। ছাত্র উপদেষ্টা ড. এম. তারেক নূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘কেবল চাকরি নয়, অন্যদেরও উদ্যোক্তা হতে বলব আমি। কেননা শারমিন তাদের অন্যতম উদাহরণ। আমাদের দেশের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা নানা ভুবনে আলো ছড়িয়ে চলেছে। তাকে আমি ধন্যবাদ দেই।’
ওএফএস।