সেতুবন্ধন উন্নয়নের মালা
আবু নাছের ভূঁইয়া
নদীমাতৃক বাংলাদেশ কথার সহজ অর্থ হচ্ছে, নদী আমাদের জীবনব্যবস্থার মা। নদ-নদীর পলি হতেই প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ ব-দ্বীপটির গড়ে উঠা বা জন্ম। দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে তাদের কোনো বিকল্প নেই। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা যেমন আমাদের অস্তিত্ব তেমনি এই অঞ্চলগুলোকে আলাদাভাবে সমৃদ্ধ করেছে।
নদ-নদীর সমৃদ্ধি যেমন আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে আবার তাদের বিশালতা আমাদের একটি অঞ্চল থেকে আরেকটির সড়ক ও নৌ-যোগাযোগের দূরত্ব তৈরি করছে। ফলে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও লেনদেন উন্নয়নের যুগে ব্যহত করছে। এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম করিডোর হলো যোগাযোগ বা কানেক্টিভিটি। পদ্মা সেতু যেমন পুরো দক্ষিণাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকা এবং এক অর্থে পুরো দেশের সাথে যুক্ত করেছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য।
একসময়ের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন দক্ষিণাঞ্চলের জনগণকে তাদের লালিত স্বপ্ন বা মিথ বাস্তবে ছুঁয়ে দেখার অনুভুতি দিয়েছে। এখন আঞ্চলিক সেতুগুলো অর্থ-বাণিজ্যের সংযোগ হিসেবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে এক সুতোয় যুক্ত করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন অগ্রযাত্রার নতুন মাইলফলক হয়েছে।
আমাদের এই পদ্মা বহুমুখী সেতু বাংলাদেশের সক্ষমতা ও সম্ভাবনারও উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে যাবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লাইফ লাইন হয়েছে। অবারিত সম্ভাবনার এ সেতু উদ্বোধনের পর একের পর এক নতুন কানেক্টিভিটি ডানা মেলতে শুরু করেছে।
গোপালগঞ্জ-নড়াইলে ‘মধুমতি সেতু’ এবং নারায়ণগঞ্জ বন্দর-জেলা সদরে নির্মিত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমান সেতু (তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু)’ আলোচনায় বলছি। এই বছরের ১০ অক্টোবর সেতু দুটি উদ্বোধন দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে নিঃসন্দেহে। আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনেও।
পদ্মা সেতু হয়ে দেশের বৃহত্তম বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সাথে ও বেনাপোল স্থলবন্দরকে সংযুক্তি আমাদের অর্থনীতিতে নতুন ইতিহাসটি রচনা করেছে।
বাংলাদেশের প্রথম ছয় লেনের দৃষ্টিনন্দন মধুমতি সেতু নড়াইল ও গোপালগঞ্জের সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। মধুমতি পাড়ের সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। স্পষ্টভাবে বোঝা গিয়েছে, নড়াইলবাসীর চোখে, মুখে আবেগ উচ্ছ্বাস এবং আনন্দ দেখে।
বিখ্যাত ‘নদীর নাম মধুমতি’ চলচ্চিত্রে অনেকেই আমরা দেখেছি বা পড়েছিও- সবুজ প্রকৃতির কোল ঘেঁষে বয়ে চলা কোমল ও মিষ্টি মধুমতি নদীর নামটিই সেতু তৈরির সময় নাম দিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। নামকরণ স্বার্থক হয়েছে। মধুমতি সেতু আমাদের জীবনের আরেকটি রূপ। তার সরকারের ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়ন ও বাংলাদেশকে আধুনিক, সমৃদ্ধ, উন্নত দেশে পরিণত করতে বহুকালের যে স্বপ্নযাত্রা তারা গ্রহণ করেছেন, অর্থনৈতিক কানেক্টেভিটিগুলো উদ্যোগটিতে অনন্য ভূমিকা পালন করে যাবে।
মধুমতি সেতু এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়ার ফলে অর্থেনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যাবে। তাই সেতুদ্বয় ছয় লেনের সেতুতে রূপদান করা হয় বাংলাদেশে একমাত্র হিসেবে। আর মধুমতি সেতু চালু হওয়ায় ঢাকা থেকে নড়াইলের দূরত্ব হলো মাত্র ১শ ১৩ কিলোমিটার। সেতুটি চালু হওয়ায় আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলা থেকে বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল ও সাতক্ষীরার ভোমরা সরাসরি সংযুক্ত হলো। কালনা নদীর ওপর মধুমতি সেতু দেশের বণিজ্যিক কার্যক্রমে অত্যন্ত গতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বড় ভূমিকা রেখে যাবে। দেশী-তো বটেই বিদেশী বিনিয়োগ আসবে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এখানে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। জেলা শহরের অদূরেই হতে যাচ্ছে আরেকটি বিসিক শিল্পনগরী। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তনের হাতছানি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্নও পূরণ হবে। সেতুর পূর্ব পাড়ে গোপালগঞ্জ কাশিয়ানী ও পশ্চিম পাড়ে নড়াইল লোহাগড়া উপজেলা। নান্দনিক নির্মাণশৈলী ও অনন্য স্থাপত্য কৌশলটি সেতুকে আকর্ষণীয় করেছে। মাঝখানে বসানো ভিয়েতনামে তৈরি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ১শ ৫০ মিটার দীর্ঘ নেলসন লস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) স্টিলের স্প্যান পর্যটন আকর্ষণ সবসময় বাড়িয়ে যাবে। জাপানের বিখ্যাত নিপ্পন কোম্পানির স্প্যানটি সেতুকে স্থায়ীত্ব দিয়েছে।
৬শ ৯০ মিটার দীর্ঘ ২৭.১ মিটার চওড়া সেতুটিতে চারটি উচ্চগতির লেন, দুটি সার্ভিস লেনে সমৃদ্ধ। আছে ৪.৩০ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোডও। ফলে যোগাযোগ নিরাপদ হলো। সহজ হলো।
একই সময়ে উদ্ধোধন হওয়া নারায়ণগঞ্জ বন্দর-জেলা সদরে বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমান সেতুটিও খুলে দেওয়ার পর দেশের তিনটি জাতীয় মহাসড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-মাওয়া-খুলনা একে-অপরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হলো।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমান সেতুটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে পদ্মা সেতুর দূরত্ব কমাবে অন্তত ৯ কিলোমিটার। দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের দূরত্ব অন্তত ২০ কিলোমিটার কমবে। এখন থেকে ওই দুই পথের যাত্রীদের ঢাকা হয়ে আর কোনাদিন চলাচল করতে হবে না। সে কারণে অন্তত দুই ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হবে যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনে। দক্ষিণের যাত্রীরা পদ্মা সেতু দিয়ে মুন্সীগঞ্জ হয়ে শীতলক্ষ্যা সেতু দিয়ে মদনপুর হয়ে চট্টগ্রাম এবং সিলেট যেতে পারবেন। এই সেতু চালুর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর সাথে সংযোগ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের। যারা খুলনা, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়ার মানুষ, তারা পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা শহরে প্রবেশ না করেই সরাসরি চট্টগ্রাম যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে বড় দূরত্ব কমে যাবে। তৈরি হলো অর্থনৈতিক অপার সম্ভাবনা। বৃদ্ধি পেল অর্থ ও বাণিজ্য গুরুত্ব।
১.২ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২২. ১৫ মিটার প্রশস্ত মুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমান সেতু। বহু শতাব্দী আগে থেকে রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার পাশের বিখ্যাত বন্দরনগরী ও অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে অন্য জেলাগুলোর বাণিজ্যিক সংযোগ ঘটালো সেতু পথে। সেতুটিতে ধীরগতির গাড়ি (রিকশা-সাইকেল) চলাচলের জন্যও আলাদা দুটি লেন রাখা হয়েছে। আছে পায়ে হেঁটে পারাপারের জন্য ফুটপাত। ফলে স্থানীয় জনগণের যোগাযোগ আরো সহজ হলো।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমান সেতু নারায়ণগঞ্জবাসীর নিত্য যোগাযোগ সহজ করলো। ঢাকা শহরের যানজট নিরসনেও ভূমিকা রাখতে শুরু করলো। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত এই সেতুটি লক্ষাধিক মানুষ নৌকা ও ট্রলারে খেয়া পারাপারের ভোগান্তির অবসান ঘটালো। সেতুর সঙ্গে নতুন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলো। ফলে আরো কাজ করলে মুন্সীগঞ্জসহ আশেপাশের মানুষ পদ্মা সেতু থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা লাভ করবেন। শেখ হাসিনা সরকারের দূরদর্শীতার অনন্য প্রমাণ বাংলাদেশের এই রূপান্তরগুলো। তার নেতৃত্বের স্বারক সেতুবন্ধন। আগামী প্রজন্মের উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন প্রাণসঞ্চার।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক।
ছবি : বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমান সেতু, মধুমতি ও পদ্মা সেতু।
ওএফএস।