সহমর্মিতা, সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন
‘শোনা গেল লাশ কাটা ঘরে/নিয়ে গেছে তারে;/ কাল রাতে –ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/মরিবার হল তার সাধ’। (জীববানন্দ দাশ)
আমরা এমন ঘুম চাইনি পারমিতা । তোমার জন্য নয় পৃথিবীর আর কোন মানুষের জন্যও নয়। কোনোদিন না জাগার বেদনা নিয়ে অবিরাম ভার নিয়ে কোন স্বপ্নের অপমৃত্যু আর চাই না । এক সময় এই সমাজ ছিল ‘আমরা’ কেন্দ্রিক ধারণায় লব্ধ। যা কিছু সবটাই আমাদের, কর্মফল ও দ্বায়িত্ব। যাবতীয় কাজ ব্যক্তিবিশেষ, নয় ব্যক্তি নির্বিশেষ। পরবর্তীতে আমরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠলাম। ব্যক্তি মানুষের নানা অর্ন্তমুখী চিন্তা তথা-অস্তিত্ববাদ ক্রমশ আমাদের মধ্যে প্রোথিত হতে লাগল আর পরস্পরের কাছ থেকে খুব সূক্ষ্মভাবে বিছিন্ন হতে থাকলাম। নানামুখী সংকটের শুরু তখন। অবসাদ, নৈরাশ্যবাদ যেন আরো এক বিপন্ন বিস্ময় হয়ে আমাদের অন্তর্গত রক্তের মধ্যে খেলা করে তাই বুঝি পারমিতারা সমাজের সাথে যুঝে উঠবার রসদ জোগাতে পারেনা। পারমিতা আমাদের কাছে প্রতিটি জীবন একটি অস্তিত্বের একান্ত গভীর অনুভুতি , বেদনা ও বিচ্ছিন্নতার ক্লান্তিকর ক্ষত, সম্ভাবনার অপমৃত্যু, দিনশেষে কাঁটাতারের প্রজাপতি।
জাঁ পল সার্ত্রের নসিয়া উপন্যাস ব্যক্তি জীবনের নিঃসংঙ্গতাবোধের এক অসাধারণ উপস্থাপন। চিত্রিত হয়েছে অ্যান্টোআইন রোকেন্টিন নামের এক ব্যক্তি কিভাবে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তার পরিবেশ, প্রিয়জন এমনকি সবচেয়ে কাছের মানুষ প্রেমিকা অ্যাানির কাছে থেকে ক্রমে বিছিন্ন হয়েছেন। এই যে আমরা ক্রমশ একলা হচ্ছি, কারণ কি? আমাদের অবসাদ, ক্লান্তি, যন্ত্রণাকে ঠেলে কেন বেঁচে থাকার তাগিদগুলো অনুভব করছি না? কেন জীবন বার, বার পরাজিত যাচ্ছে মৃত্যুর কাছে? জীবনের প্রতি এত বিতৃষ্ণা কেন জন্মাচ্ছে?
ঝাঁ চকচকে সুগন্ধে মোড়া, ফাঁপা অন্ত:সারশুন্য যে নাগরিক জীবন বেছে নিয়েছি আমরা, সেখানে কোন আরাম নেই, শান্তি নেই, বিশ্রাম নেই শুধু আছে অবিরাম ছুটে চলা। আমরা একে অপরের থেকে ক্রম দূরবর্তী হচ্ছি। মহানগরের তপ্ত দুপুরের গিজ, গিজ করা মানুষদের মধ্যে যোজন, যোজন ব্যবধান । নাট্যকার লুইজি ব্রায়ান্টের ‘দ্য গেম’-এ একটি তরুণী আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। খেলা শুরু করে জীবন–মৃত্যু নামে দুটি চরিত্র। জীবন–মৃত্যুর ঘূর্নায়মানতার নিরন্তন দ্বন্দ্বে জীবনই জয়ী হয় সেখানেও। ফলে যাই ঘটুক, যত আঘাত, দুঃখের তীব্রতা, আসুক হতাশা–জীবন অপার সম্ভাবনাময়। তাই আত্মহত্যা নয়। এমন বার্তাই বহন করেন লুইজি ব্রায়ান্ট। তার নাটকটিতেও জীবনের অপার সম্ভাবনাকে ভালোবাসার আশায় আবার নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণায় জেগে উঠতে দেখা যায় সবাইকে। বাস্তবে এই স্বপ্ন বা আশা ব্যর্থ হওয়ার কারণ? কেন আত্মহত্যার মতো কাজে মানুষের জীবনবোধ ও বেচেঁ থাকার তীব্র ইচ্ছার পরাজয় ঘটছে?
মানুষ কোন চিরন্তন ধারনায় বদ্ধ নির্দিষ্ট সীমায় বাঁধা নয় । তার অবস্থান, পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে, কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ব্যক্তির মূল্যবোধ, ইচ্ছা,আগ্রহ ও অনুভূতি। মানুষকে প্রতিনিয়ত সময়ের সাথে যুঝে মানুষ হয়ে উঠতে হয়। তাহলে কী পরিস্থিতি ও পরিবেশের মধ্যে আমরা আছি যেখানে পারমিতারা মানুষ হয়ে ওঠার লড়াইটি লড়তে চায় না। মনোবিজ্ঞানীর ভাষায়- মানুষ হতাশ হলে ঠুনকো কারণেও আবেগ ধরে রাখতে পারে না। তখন নিজেকে একা মনে করে। আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ধীরে, ধীরে খারাপ পরিণতিতে। আপাতদৃষ্টিতে, অন্যদের কাছে মৃত্যু মনে হলেও সেটি জীবনের পরাজয়। ওই মুহূর্তে সেই ব্যক্তির জন্য অনেক বড় কারণ হয়ে সামনে এসেছিল মরণ।
অনেকটা সেই বালকরা আর ব্যাঙদের গল্পের মতো। পুকুরের ঢিল ছোঁড়া তাদের কাছে নিছক আনন্দের কিন্তু ফল হলো অত্যন্ত মারাত্মক। তাদের আনন্দ অন্যের মৃত্যুর কারণ হয়েছে । তাই যে বিষয়টি আপনার আমার জন্য অত্যন্ত তুচ্ছ আপনি বা আমি কোন কারণই খুঁজে পাই না জীবনকে শেষ করে দেওয়ার জন্য সেখানে যিনি আহত, রক্তাক্ত- তার কাছে সেটিই অনেক বড় কারণ । মানুষ কিন্তু কারণের জন্যই আত্মহত্যা করে তা কিন্তু নয় বরং যখন অপমানিত বোধ করে; যখন সে কোনো ব্যক্তি, কারো আচরণ, কোনো পরিবেশ, পরিস্থিতির মাধ্যমে বারংবার সহিংসতার শিকার হয়, সহানুভুতির বদলে যখন একাকী, নি:সঙ্গতায় হতাশার অন্ধকারে জীবনের সুন্দর অর্থ তার কাছে অধরা হয়ে যায় ফলাফল হয় জীবননাশ। জীবনের ইতি ঘটানো ব্যক্তিটির কাছে একটা সমাধান হয়। যাবতীয় যন্ত্রণা ও ব্যর্থতা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে পথটিকে বিবেচনা করেন । মনোবিজ্ঞানীরা বলেন টানেল ভিশন। চিন্তার শূন্যতা । যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা লোপ পায় তখন ।
মানুষের চিন্তা ,অবসাদ বিষন্নতা ও ক্ষয়ে যাওয়া, সহ্য, শক্তি, মানিয়ে নেওয়ার অক্ষমতা একদিনে হয় না। সমস্যাটি একদিনের নয়। পারমিতাও হয়ত বিষন্ন ছিল, আহত ছিল, ভীত ছিল ভিতরে, ভিতরে ক্ষয়ে গিয়েছিল। নির্মমতা হলো আমরা কেউ বুঝতে পারলাম না। অনেক ক্ষেত্রে ধার্তব্যের মধ্যেই ধরলাম না। প্লেটো ‘ক্রাইসিস অব ফ্রেন্ডশিপ’তে প্রশ্ন করেছিলেন-মানুষ আত্মহত্যা করে কেন ? উত্তর ছিল সহায়হীন হলে। সহায়ক তবে কে? প্লেটোর উত্তর-বন্ধু, তারাই স্বজন। তিনি বইতে বিশদ আলোচনা করেছেন তার উপযোগিতা ও আনন্দ তত্ত্বের ভিত্তিতে। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো কাছের মানুষের সাহচর্য। কাছের মানুষদের ভুমিকা ও দায়িত্ব আজও সবচেয়ে বেশি। খুব সাধারণ বোধেই মানুষ বিপন্ন হলে তার কাছের মানুষের সান্নিধ্য সবার আগে খোঁজেন। তাই শোনার প্রবণতা রোধ করে সব দুর্ঘটনা। সহমর্মিতা ও মন খুলে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়ে উঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান। প্রিয় জীবন সুন্দর করতে প্রেম, আশা, বিশ্বাস, সহানুভুতি ও মানবিকতার প্রয়োজন। প্রিয়জন ছাড়া সম্ভব? হু’র মতে, মানসিক সুস্থতা হলো, কোনো ব্যক্তি যখন নিজের স্বক্ষমতা বুঝতে পারেন, তখন জীবনের স্বাভাবিক চাপগুলো তিনি মানিয়ে নিতে পারেন, উৎপাদনশীলতায় কাজ করে যেতে পারেন। নিজ অবদান রাখতে পারেন এই যোগ্যতাগুলো অর্জন করতে সহমর্মিতা, সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন। র্নিমাণ করার দ্বায়িত্ব কাদের? শৈশব, কৈশোর হবে আনন্দময়। তারুণ্য সাহসী, উদ্যামী। কেন নিরাশার অন্ধকার গহব্বরে হারিয়ে যাবেন? সুন্দর সুনিশ্চিত ভবিষৎ নির্মাণের স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি। সেখানে পৌঁছাতে আমাদের পারমিতাদের মৃত্যু নিয়ে ফল্প্রসূ চিন্তা করার সময় থাকতে হবে। আমরা আত্মহত্যা দিবস পালন করব, আলোচনা করব, সেমিনার করব কিন্তু দিন শেষে বেড়াব, ভালো থাকব, কাজ করব। আর সম্ভাবনাময় জীবনগুলোর মহীরুহ হয়ে উঠতে না পারায় নিজেদের প্রশ্ন করা ছাড়া আর কী কোনো উপায় আছে আমাদের কারো?
(পারমিতা নামটি রূপকার্থে ব্যবহার করা হয়েছে এই বিশেষ রচনায়)
নবনীতা চক্রবর্তী, প্রভাষক, নর্দান ইউনির্ভাসিটি, বাংলাদেশ।
ওএফএস।