‘আমরা আমাদের সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাই’
খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ টাস্ট্রের সদস্য সচিব নির্মল রোজারিও। সাবেক উচ্চপদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা। খ্রিস্টান সমাজের জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্ম কাজ, ভবিষ্যত, সংগ্রাম ইত্যাদি সবই বলেছেন ওমর শাহেদকে
কীভাবে আপনাদের শুরু?
‘খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট অধ্যাদেশ ১৯৮৩’, তখন জারি করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশ অনুসারে ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট শুরু। একই সঙ্গে তখন হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট অধ্যাদেশও জারি হয়েছে। তাদের ট্রাস্টগুলো পরের বছরই শুরু হয়েছে। কিন্তু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেই আমাদের ধর্মগুরুরা ভেবেছেন-এই কল্যাণ ট্রাস্ট্রে যোগদান করা তাদের জন্য কতটুকু ভালো হবে? সহায়ক হবে? কী হবে ভবিষ্যতে? এই চিন্তা-ভাবনা থেকেই আসলে ট্রাস্টটি গঠন করেননি। যদিও এরপর বিভিন্ন সময় কিছু ব্যক্তি বিশেষভাবে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারা সাধারণ খৃস্টভক্ত। যেহেতু চার্চের মন্ডলী বা আমাদের কতৃপক্ষের একটি দ্বিমত ছিল, ফলে আলটেমিটলি এই ট্রাস্ট এতদিন করা সম্ভব হয়নি। ট্রাস্টটি আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের নিবাচনের পর যখন গঠন হলো, ২০০৯ সালে এরপর জুন-জুলাই মাসে আমাদের ধর্মবিষয়ক স্থায়ী কমিটিতে সংসদে এই বিষয়টি এভাবে আলোচনায় এলো-যতটুকু জানতে পেরেছি আমরা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এভাবে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন-‘মুসলিমদের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন আছে, হিন্দুদের জন্য হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, বৌদ্ধদের জন্য বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আছে। খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট নয় কেন?’ আলোচনাটি ধর্ম মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান খানের আমলে এলো। তিনি পটুয়াখালী থেকে নির্বাচিত এমপি ছিলেন। জানানো হলো যে, আমাদের ঢাকার আর্চবিশপ মহোদয় পলিন এস. ডি. কস্তাকে যেন এ বিষয়ে চিঠি লেখা হয়। সংসদের স্থায়ী কমিটিতে সিদ্ধান্তটি হবার সময়, সেখানে কমিটিতে ছিলেন তৎকালে প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন এমপি। তিনি পরে এসে আমার সঙ্গে আলোচনা শেয়ার করলেন। কারণ তিনি পালামেন্টে যা কিছু বলতেন, আগে অথবা পরে আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন। যেহেতু তিনি প্রেসিডেন্ট, আমি বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের তখন মহাসচিব। আমাদের দুজনের খুব ভালো বোঝাপড়া ছিল। জানার পর বললাম, এই ট্রাস্ট্র তো এভাবে হবে না। বললেন, ‘কেন হবে না?’ বললাম, আমাদের ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনের অধ্যাদেশ ১৯৮৩ সালে যখন জারি হলো, পরে চার্চের পক্ষ থেকে বলা হলো, তারা এই ট্রাস্ট্রে সংযুক্ত হবেন না। তারা এই অলিখিত সিদ্ধান্ত দিলেন তখন। তিনি বললেন, ‘কী করা যাবে? প্রতি মাসে প্রতিটি স্থায়ী কমিটির একটি করে মিটিং হয় আমাদের।’ বললাম, পরবতী সভায় আপনি একটি রেটিফিকেশন আনতে পারেন। সেখানে বলতে পারেন, চিঠিখানা আর্চবিশপের বরাবরে না লিখে বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের বরাবরে যেন লেখা হয়। পরের সভায় তিনি বললেন, ‘আগের যে সিদ্ধান্ত ছিল, সেটি আমি রেটিফিকেশন বা সংশোধন করে বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনকে যেন লেখা হয়-এই চাই।’ রেজ্যুলেশন হলো এবং তারা বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের বরাবরের একটি চিঠি লিখলেন। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির রেফারেন্স দিলেন তারা। এরপর চিঠি আমাদের দিলেন তারা।
তারপর কী হলো?
আমি আমাদের বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের ১৭ সদস্যের স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা করলাম। সবাই আলোচনা করলাম। আমরা বললাম, এই দেশের সাধারণ খ্রিস্ট ভক্তদের জন্য এবং বাংলাদেশের খ্রিস্টানদের সবার মঙ্গল বিবেচনায় কল্যাণ ট্রাস্টটি অসলে করা উচিত। আমাদের সিদ্ধান্তটি হলো। এরপর ধর্ম মন্ত্রণালয়কে অ্যাসোসিয়েশনের পত্র দ্বারা অবহিত করলাম। ১১ জনের নাম সেখানে প্রস্তাবনা আকারে আমরা তাদের কাছে জমা দিলাম পরে। তখন আসলে ছিল সাত সদস্যের কমিটি। আমরা বলেছি, আমাদের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অথবা প্রতিমন্ত্রী পদাধিকারে সভাপতি হবেন। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকে একজন ভাইস চেয়ারম্যান হবেন। বাকি ৫ জন ট্রাস্টি থাকবেন।
কল্যাণ ট্রাস্ট কীভাবে রূপ পেল?
আমাদের সাতজনের নামের প্রস্তাবনা ধর্ম মন্ত্রণালয় মেনে নিল। সেখান থেকে ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট অধ্যাদেশ অনুসারে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হলো। একটি গেজেট নোটিফিকেশন হলো। সেখানে অ্যাডভোকেট শাহজাহান খান ধর্ম প্রতিমন্ত্রী, প্রথম চেয়ারম্যান হলেন। অ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন এমপি ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। বাকি ছিলেন তখন, ট্রাস্ট্রি বোডের পাঁচজন। আমি ছিলাম নির্মল রোজারিও। মিস্টার হিউবার্ট গোমেজ ছিলেন। জেমস সুব্রত হাজরা ছিলেন। উইলিয়াম প্রলয় সমাদ্দার ছিলেন। মিসেস রীনা দাস ছিলেন। এই হলো খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। অধ্যাদেশ জারি হবার পর ২৬ বছর পর ট্রাস্টি বোর্ড হলো।
আর্থিক সহযোগিতা কীভাবে পেলেন?
এরপর থেকে আমাদের কমকান্ড শুরু হলো। আমরা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ শুরু করলাম সবার আগে। সে সময় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলাম। অ্যাসিসটেন্ট জেনারেল ম্যানেজার ছিলাম সর্বশেষ। এরপরও আমাদের কার্যক্রম শুরু করতে একটু দেরী হলো এই কারণে যে, ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশ অনুসারে সেখানে যে এনরোলমেন্ট তহবিল ছিল, ছিল মোটে ১ কোটি টাকার। এই টাকার সুদ দিয়ে তো কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। এ বোঝাপড়া থেকে মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সানুগ্রহে এই ফান্ডকে ৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হলো। যেহেতু এ একটি অধ্যাদেশ এবং এই অধ্যাদেশের মধ্যে ছিল ৫ কোটি টাকা দেওয়া হলো; ফলে আবার সংসদে যেতে হলো। এরপর ১০১১ সালে সংসদ থেকে পূর্ণ অধ্যাদেশটি হাল নাগাদ করে পাশ হয়ে এলো। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি ফিক্সড ডিপোজিট করা হলো। ৫ কোটি টাকা। ধর্ম মন্ত্রণালয় আমাদের অনুকূলে ডিপোজিট করলো এবং তারাই পুরোপুরিভাবে এই টাকা হ্যান্ডেল করেন। সেটির ইন্টাররেস্ট শুধু আমরা পাই। যেহেতু কল্যাণ ট্রাস্ট, ফলে তখনো কোনো দপ্তর আমাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এই ফিক্সড ডিপোজিট ম্যাচিউর হলো এবং আমরা প্রথম ইন্টারেস্ট পেলাম ২০১২ সালের মাচ-এপ্রিলের দিকে। তিন মাস অন্তর টাকা পাই। তখনো আমাদের কোনো অফিস ছিল না। কিন্তু ট্রাষ্ট্রি বোর্ড আছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ে তো আমরা বসি না। আমাদের একটি অফিস দরকার।
আপনি কীভাবে ট্রাস্টি বোডের সদস্য সচিব হলেন?
এই সময়ের মধ্যে, বতমান যে সিএসই (প্রধান নিবাচন কমিশনার)-জনাব হাবিবুল আওয়াল, তিনি তখন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। একদিন আমাকে ডাকলেন। বললেন, ‘নির্মল, তুমি যদি এই ট্রাস্ট্রি বোডের সাচিবিক দায়িত্বটি না গ্রহণ করো, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানটিকে আসলে দাঁড় করানো যাবে না।’ এই সময়ের মধ্যে কয়েক বছর পারও হয়ে গিয়েছে। ২০০৯ সালে গড়ে উঠেছে, আর তখন ২০১১ সাল, তখনো কাজ শুরু করা যায়নি। ফলে একটি চাপ তৈরি হলো। বললাম, স্যার আমি তো ব্যাংকে আছি। বললেন, ‘তাতে কোনো অসুবিধা নেই। সেটি সরকারের প্রতিষ্ঠান আর একটিও সরকারী প্রতিষ্ঠান। তবে আমি তোমাকে ডেপুটেশনে নয়, সংযুক্তির ভিত্তিতে নিয়ে আসবো। অ্যাটাসমেন্টের ভিত্তিতে নিয়ে আসলে তোমার সমস্ত বেনিফিট ঠিক থাকবে। তুমি এখানে আসো এবং এই ট্রাস্টটিকে দাঁড় করাও।’ বললাম, আপনি যদি চান তাহলে আমার আপত্তি নেই। যেহেতু আমাদের উদ্যোগেই ট্রাস্ট হয়েছে। ট্রাস্ট আমাদের কমিউনিটির জন্য কাজ করবে। আওয়ামী লীগের সময়ে এই ট্রাস্ট্র হয়েছে। কারণ আগে তো হয়নি। আর এই ট্রাস্ট্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়। কারণ অসাম্প্রদায়িক দেশ হতে হলে তো সকল ধর্মের কাজের সুযোগ থাকতে হবে। এই কমিউনিটিকে বাদ দিয়ে তো সেটি হয় না। এই ট্রাস্ট্র যে সরকারের একটি অ্যাচিভমেন্ট, সেটি আমাদেরও একটি অনুভূতি ছিল। তো এরপর পর তিনি স্যার-সচিব হাবিবুল আওয়াল আমার ব্যাংকের এমডি স্যারকে চিঠি লিখলেন। এমডি স্যার ওখান থেকে মতিউর রহমান পাটোয়ারী স্যার অর্থসচিব, তার সঙ্গে কথা বললেন। এরপর অনুষ্ঠানিকভাবে ২০১১ সালের নভেম্বরের দিকে সচিব হিসেবে এখানে চলে এলাম আমি।
অফিস কীভাবে হলো?
সচিব হিসেবে আসার পর থেকে হাবিবুল আউয়াল স্যার বললেন, ‘তুমি একটি সুন্দর অফিস নাও। কারণ এখানে তো বিদেশী, দূতাবাসের লোকেরা আসবেন। নানা ধরণের লোক আসবেন।’ ফলে ৮২ নম্বর তেজকুনি পাড়া, ফার্মগেটে আমি একটি সুন্দর অফিস নিয়েছিলাম। ২০১২ সালের এপ্রিলে উদ্বোধন করা হয়েছিল। আমরা বিদেশী অতিথিদের দাওয়াত দিয়েছিলাম। আমেরিকান অ্যাম্বাসির আন্ডার সেক্রেটারি-জোয়ান্না, তিনিও এসেছিলেন। আমাদের এই অফিস উদ্বোধন হলো এভাবে ২০১২ সালে।
কাজের শুরু?
তারপর তো আমাদের কার্যক্রম চলে এলো। তখন ৫ কোটি টাকার ডিপোজিট ছিল। আমাদের অনেক আয় ছিল। কেননা তখন তো ব্যাংক সুদের হার ১৩ শতাংশ ছিল। কিন্তু এখন তো কমে গিয়েছে। হয়ে গিয়েছে ৫ থেকে ৫.৫০ শতাংশ। তো এই ট্রাস্ট্র শুরু করার পর থেকে আমরা সেই সুদের টাকা থেকে কাজ করতে লাগলাম। তারপর হাবিবুল আওয়াল স্যার বললেন, ‘নির্মল তুমি দৌড়াদৌড়ি করতে পারবে না।’ এর মধ্যে ২০১২ সালের শেষের দিকে একটি ইন্টারেষ্ট এলো। ফলে বললেন, ‘তুমি যে সুদের টাকা আছে সেখান দিয়ে একটি গাড়ি কিনো।’ আমাকে তিনি গাড়ি কেনার কথা বললেন। ‘তুমি তো একটি গাড়ি না হলে কাজ করতে পারবে না।’ তিনি কিন্তু তার প্রটোকলের বাইরে গিয়ে ভালোবাসা থেকে আমাকে এই কথা বললেন। কত সর্মথন ও সহযোগিতা কত ভালো মানুষ হলে, কর্মদক্ষ হলে একজন মানুষ এই কাজগুলো করতে পারেন। তিনি আমাকে হাতে ধরে খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট্রে সচিব করলেন। অত্যন্ত দয়ালু লোক। পরে আরেকজন সচিব আনিছ স্যার (আনিছুর রহমান) তিনিও আমাদের নির্বাচন কমিশনের সদস্য, আগে একজন সচিব ছিলেন, এখন আছেন আমাদের সৌদি আরবের হজ্ব অফিস জেদ্দায়। তিনিও অনেক কাজ করেছেন। তারা তিনজনই আগে, পরে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। আমাদের খুব সহযোগিতা করেছেন। এরপর তো হাবিবুল আউয়াল স্যারের কথায় ট্রাস্টের অধীনে গাড়িটিও কিনলাম। ২০১২ সালে।
আপনাদের সাহায্য প্রদান? প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য?
আমরা আমাদের অনুদান দেওয়া শুরু করলাম ২০১২ সাল থেকে। এ যাবৎ আমাদের এনরলমেন্ট (তালিকাভুক্ত) তহবিল বা আমাদের সিড মানি তহবিল ওই যে পাঁচ কোটি টাকা সেটির ইন্টারেস্ট বা সুদ থেকে ৫শ ৫২টি গির্জাকে মোট ২ কোটি ৬৯ লাখ ৭৩ হাজার অনুদান টাকা দিয়েছি। এছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদেরকে গত বড়দিনে ২ কোটি টাকা দান করেছেন। তার অগের বড়দিনে এক কোটি টাকা দান করেছেন। তারও আগের বড়দিনে ১ কোটি টাকা দান করেছেন। তার আগের বড়দিনে ৫০ লাখ টাকা দান করেছেন। উল্লেখ্য, প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন হয়। এতগুলো টাকা তিনি আমাদেরকে দিয়েছেন। আমাদের প্রধান উৎসবটি পালন করার জন্য মোট সাড়ে চার কোটি টাকা দিয়েছেন। এই জমানো টাকা থেকে এই যাবৎ আমাদের বিতরণ হয়েছে মোট ৬শ ৯৮টি গিজার উন্নয়ন ও স্থাপনের জন্য। আমরা দিয়েছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে পাওয়া টাকার মধ্যে ৩ কোটি ৪১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা আমরা দিয়েছি। আরো কিছু টাকা ডিসট্রিবিউশন এই বড়দিনের আগে আমরা আবার করব। এখনো সেই টাকাগুলোর মধ্যে কিছু টাকা দেওয়া বাকি আছে। আমরা বিতরণ করবো।
কোন, কোন প্রতিষ্ঠানকে কী, কী সাহায্য করেছেন?
আমাদের ‘সান ডে স্কুল’ আছে। আমাদের শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্য বিদ্যালয়ের বাইরেও এই বিদ্যালয়গুলোকে সানডে স্কুল বলি, সেগুলোর জন্য তিনটি চার্চ অগানাইজেশনের জন্য দিয়েছি দেড় লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫টি চার্চ অথবা চার্চ সংঘ, ফেডারেশনকে দিয়েছি ৫ লাখ টাকা। টাস্ট্রের পক্ষ থেকে এই যাবৎ মোট প্রদান করা অনুদান হলো আমাদের ৬ কোটি ৮ লাখ ১৮ হাজার টাকা। এই টাকাগুলো দিয়েছি। আমরা ট্রাস্ট্রের অধীনে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছি ২০১৫-’১৬ সাল থেকে। আমরা পালক, পুরোহিতদের (ফাদার, ব্রাদার, সিস্টার) দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ কমশালা ২০১৫-১৬ সাল থেকে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে করেছি মোট ৭টি। তাতে অংশগ্রহণ করেছেন মোট ৬শ ৬ জন ফাদার, ব্রাদার, সিস্টারস আন্ড প্যাস্টরস। যুবক-যুবতীদের নীতি ও নৈতিকতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কমশালা তখন থেকে আজকে পর্যন্ত মোট ১৮টি আয়োজন করেছি। এখানে মোট ১ হাজার ৬শ ২৭ জন ছেলে, মেয়ে অংশগ্রহণ করেছে। তারা সাধারণ ছাত্র, যুবকদের মধ্যে একটু সামনের সারিতে আছে। এই কার্যক্রম শুধু ঢাকার মধ্যে নয়, পুরো বাংলাদেশ জুড়ে করেছি। ঢাকা, বরিশাল, সম্প্রতি পাহাড়ের তিনটি জেলা-বারন্দবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির জন্য করেছি গত মাসে। ময়মনসিংহ, দিনাজপুর ও রাজশাহীতে প্রশিক্ষণ কমশালাগুলো আয়োজন করেছি। ঢাকার বাইরে সাভারেও হয়েছে। মুন্সিগঞ্জ জেলা এবং সিলেটে হয়েছে। এই যে তখন থেকে আমরা এই কাজ আজকে পর্যন্ত করেছি, দ্যাট ওয়াজ অ্যা ক্রিটিক্যাল টাইম ফর অল কমিউনিটি পিপল। জঙ্গীবাদ, মৌলবাদের উত্থান হয়েছিল তখন। টার্গেট কিলিং হচ্ছিল।
আয়োজনগুলোর কারণ?
আমাদের উদ্দেশ্য-ফাদার ও ব্রাদারদের যে কর্মশালাগুলো, তার মূল ফোকাস ‘সম্প্রীতি’। এই সম্প্রীতি বির্নিমাণে আমাদের পালক, পুরোহিতরা আরো কী, কী ভূমিকা পালন করতে পারেন? এজন্যই কাজ করেছি। ভিন্ন ধর্মালম্বীদের মধ্যে সহাবস্থান গড়ে তোলার জন্য ছাত্র, ছাত্রী ও যুবকরা কী ভূমিকা পালন করতে পারেন পরের কর্মশালাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল। এটি ছিল তাদের প্রশিক্ষণগুলোর মূল ফোকাস। আসলে সম্প্রীতি বিনির্মাণের জন্যই আসলেই আমাদের পালক পুরোহিত ও ছাত্রদের এই প্রশিক্ষণগুলো তখন থেকে শুরু করেছি। এখনো কার্যক্রমগুলো চলমান রয়েছে।
এখন কার্যক্রম?
এখন অমাদের কার্যক্রম...আপনি তো জানেন, এখন আমাদের দেশের সরকারের কার্যক্রম হয় অ্যানুয়াল পারফরমেন্স এগ্রিমেন্টের ভিত্তিতে হয়। এই কাজকে ‘এপিএ’ বলি। গত বছর থেকে এই বছরের জুন পর্যন্ত আমি কী কাজ করবো, সেটি গেল জুনে একটি চুক্তির ভিত্তিতে শুরু হয়েছে। আমার সঙ্গে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের চুক্তি হয়েছে।
জানুয়ারিতে হয় না কেন?
আমাদের এই কার্যক্রমের শুরু জানুয়ারিতে হয় না। কারণ আমাদের সবার কার্যক্রমগুলো অর্থবছরের ভিত্তিতে হয়। ফলে সেটি জুনে শুরু হয়। এই বছরের জুনে আমার সঙ্গে সচিবের চুক্তি হয়েছে। এই পারফরমেন্স এগ্রিমেন্ট। কাজগুলোর সূচক বা ইন্ডিকেটর কী, কী? কাজগুলো কী, কী হবে? সেগুলোর আউটকাম কী কী হবে-সমস্ত কিছু পরিকল্পনাটির মধ্যে রয়েছে, বলাও আছে। এখানে মোট ১শ মার্কস আছে। সেখান থেকে আমার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ভিত্তিতে মার্কিং করা হবে। গেল বছরও আমার কার্যক্রম মার্কিং হয়েছে। সেখান থেকে আমরা হয়তো ৯৭, ৯৭.৫০ বা ৯৮ নম্বর পাবো যে কাজ করেছি। এই কাজ বললে হবে না যে করেছেন, এজন্য আপনাকে প্রমাণকও দিতে হবে। লাগবে। মুখে না বলে প্রমাণ করে দিতে হয়। এই আমাদের কার্যক্রমের আজকে পর্যন্ত বিবরণ।
আগের অফিস থেকে এখানে কীভাবে এলেন? তারপর?
আমাদের সেই প্রথম অফিসটি ৮২ তেজকুনি পাড়া, তেজগাও, ঢাকা-একজন ডেভেলপারকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির মালিক দিয়েছেন। এখন এই অফিসে এসেছি। এখন আমরা ১২৮/৪ পূর্ব রাজাবাজার, ঢাকা (কারওয়ানবাজার) এসেছি। আলটিমেটলি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ২০১৫ সালে আমাদের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি মিটিং ছিল। তখন তিনি বলেছেন, আমাদের এই কার্যক্রম ও কার্যালয়টি চলে যাবে ওয়াকফ ভবনে। আমাদের মগবাজারে সেখানে আছে ওয়াকফ প্রশাসক কার্যালয়। সেখানে হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আছে। সেখানে হিন্দুদের দেবে ৮ হাজার স্কয়ার ফিট, আমাদের বাকি দুই ধর্মের কল্যাণ ট্রাস্টকে দেবে ৪ হাজার স্কয়ার ফিট করে অফিস স্পেস। এখানে আমাদের কার্যালয় থাকবে না। ওখানে কাজ চলছে। আগামী বছর মানে ২০২৩ সালে আমাদের কার্যক্রম স্থানান্তরিত করতে হবে স্থায়ীভাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সেখানে আমাদের স্থায়ী জায়গা দিয়েছেন।
কাজগুলোর পেছনে আপনার পরিশ্রম কেমন গিয়েছে?
পরিশ্রম তো বটেই, কাজ তো করতেই হয়েছে। আমি উচ্চপদস্থ সরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলাম। এই চাকরিটিও সরকারী। তবে এখানে এক্সট্রা অডিনারি কিছু কাজ তো করতেই হয় ট্র্যাডিশাল কাজের বাইরে গিয়ে। একেবারে শুরু থেকে খেটে, খেটে কাজ করতে হচ্ছে। এ-টু-জেড আমাদেরকে করতে হয়েছে। একেবারে শুরুর ফাইলিং থেকে অফিস সাজানো থেকে সবকিছু, এই প্রশিক্ষণ আয়োজন ও পরিচালনা এবং সম্পন্ন করার কাজ করতে হয়েছে। সচিব হিসেবে আমার অনেক শ্রম স্বাভাবিক। কারণ একটি নতুন প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর জন্য, একেবারে শুরু থেকে আজকের কাজ আমাদেরকে করতে হয়েছে। ফাইলিং থেকে শুরু করে অফিস সাজানো থেকে সবই হাতে গড়া। এই যে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি থেকে অনুদান প্রদান কাযক্রম সম্পন্ন করতে হয়েছে আমাদেরকে। প্রথম দিকে বলেছিলাম, আমাদের কমিউনিটি থেকে, ধর্মীয় গুরুরা চাচ্ছিলেন না। কিন্তু সেই কাজটিও আমাকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে করতে হয়েছে। এভাবে কাজ করতে হয়েছে, যেহেতু চার্চের সঙ্গেই কাজ করতে হবে এবং মূলত আমরা চার্চ ও খ্রিস্টানদের উন্নয়নের জন্য কাজ করছি, যে অধ্যাদেশ বা ম্যান্ডেট ছিল, আপনারা হয়তো দেখে থাকবেন, ম্যান্ডেটের মধ্যে ছিল যে, আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের মেরামত ও নির্মাণ এবং পবিত্র স্থানসমূহের রক্ষণাবেক্ষণই ছিল অধ্যাদেশের প্রথম অংশ। কিন্তু পরবতীতে ২০১৮ সালে আইন করা হয়েছে এবং সেখানে ডিটেইল আকারে বলা হয়েছে। সেখানে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কার্যাবলী কী, কী হবে, আগে ছিল না। আগে ছিল, খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যাবলী হবে নিম্মরূপ, যথা : খ্রিস্টান সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিকসহ সার্বিক কল্যাণ সাধন, ধর্মীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রসার ও প্রচার, বাংলাদেশে বসবাসরত সকল ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতি সুদৃঢ়করণ, এই কার্যক্রমগুলো সমন্বিত করার জন্য কার্যক্রম পরিচালনা। খ্রিস্টান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান-উপাসনালয়, কবরস্থান প্রতিষ্ঠা, সংরক্ষণ, উন্নয়ন, সংস্কার; পরিচালনার জন্য আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান। খ্রিস্টান ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং উন্নয়নে সহযোগিতা প্রদান। খ্রিস্টান ধর্ম, দশন, কৃষ্টি ও প্রাচীন ঐতিহ্যগুলো বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা। কেন্দ্রীয় ও জেলাভিত্তিক গ্রন্থাগার এবং তথ্যভান্ডার স্থাপন। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক যোগাযোগ ও উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ। খ্রিস্টান ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর নিরাপত্তা ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মের মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে খ্রিস্টান ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা প্রদান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ। অসহায় ও দু:স্থ খ্রিস্টানদের চিকিৎসা ও অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য সহায়তা এবং সহযোগিতা প্রদান। খ্রিস্টান ধর্মীয় গ্রন্থাবলী প্রকাশ, অনুবাদ এবং প্রচারকরণ। প্রাচীন ও ধর্মীয় খ্রিস্টান পুরাকীর্তি চিহ্নিতকরণ ও তাদের যথাযথ সংরক্ষণের জন্য সহায়তা প্রদান। এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণ করবে এমন অন্যান্য কার্যাবলী সম্পাদন। এই বিষয়গুলো কিন্তু অধ্যাদেশে ছিল না। এটি যেহেতু ২০১৮ সালের আইন এবং আগের সময়ের অধ্যাদেশে খুবই ন্যারোলি ছিল। কী, কী কাজ করতে পারবো-এসব। খ্রিস্টান ধর্মীয় উপাসননালয়, কবরস্থানের উন্নয়ন ও মেরামত ইত্যাদি। পবিত্রতা স্থানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এই ছিল মোটামুটি প্যারিফেরি অধ্যাদেশে। ২০১৮ সালে আইনে সেগুলোকে ডিটেইল করা হয়েছে। তবে আমাদের সব কাজ ধীরে, ধীরে ভবিষ্যতে করা হবে। খ্রিস্টান ধমীয় কল্যাণ ট্রাস্ট তো পুরোপুরিভাবে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কিন্তু আমরা একটি সংস্থা। তাদের একটি অর্গান আমরা। আমরা আমাদের সব কাযক্রম আইনের আলোকে এবং মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংযুক্তি রেখেই করব, করতে হবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়েরও উন্নতি ঘটবে।
হ্যা, তা তো বটেই। আমাদের কিন্তু প্রত্যেক মাসে মন্ত্রণালয়ে সব ধর্মের একটি সমন্বয় সভা হয়। সে সভায় সবাই যাই। সেখানে আমাদের মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি থেকে প্রথম শ্রেণীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা থাকেন। সেখানে প্রতিমন্ত্রী, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব, আমি নিজে খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব, আমাদের ওয়াকফ প্রশাসক সভায় অংশগ্রহণ করি। সেখানে গেল ১ মাসের সিদ্ধান্ত কতটুকু বাস্তবায়ন করা হলো সেগুলো আলোচনা ও মূল্যায়ন করা হয়। এই সভাগুলোকে ‘সমন্বয় সভা’ বলা হয়। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে প্রতি মাসে সমন্বয় সভা মাস্ট, ম্যান্ডেটরি, করতেই হয় সবাইকে। যত ব্যস্ততা থাকুক না কেন। যেমন করোনা ভাইরাসের আক্রমণের সময় আমরা ভার্চুয়ালি করেছি।
কিভাবে এখন কাজ করেন?
এখানে আমাদের এখন হয় পারফরমেন্স এগ্রিমেন্ট। এই এগ্রিমেন্ট সচিবের সঙ্গে আমার স্বাক্ষরিত হয়েছে। বুঝলেন? একে বলা হয় ‘বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি’। সচিব খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট ও সচিব ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। এখানে সমস্ত কিছু বলা আছে ইন্ডিকেটরসহ। কী কী করতে হবে সেগুলোও বলা আছে মিশন, ভিশন থেকে শুরু করে। এগুলোকে বলে ‘প্রমাণক’। যেমন ২০২০-’২১ অথবছরে আমি কী কাজ সম্পাদন করেছি আপনাকে প্রমাণ প্রদান করতে হবে। না হলে মাকস দেবে না। ১ শতে আপনি যদি বিলো অ্যাভারেজ হন, তাহলে আপনার পারফরমেন্স আপনি বোঝেনই তো? এটি শুধু আমাদেরকেই নয়, সব সংস্থাকেই করতে হয়। এমনকি প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে করতে হয়। এখানে প্রতিযোগিতা হয় তুমুল। কোন মন্ত্রণালয় সবচেয়ে বেশি পাবে? কোনো, কোনো মন্ত্রণালয় দেখা যায় ৯৮ পায়। বাংলাদেশে তো ৪৯টি তো মন্ত্রণালয়, আমাদের ধর্ম মন্ত্রণালয় গত অর্থবছরে ২২ বা ২৩ নম্বরে ছিল। তার আগে ১৯ ছিল। এবার একটু কমে গিয়েছে। একে বলে ‘পারফরমেন্স বেইজড ম্যানেজমেন্ট’। এখানে আসলে কারোরই আসলে ঘুমিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
আপনার স্বপ্ন?
স্বপ্ন মানে হলো, আমরা আমাদের সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাই। সার্বিকভাবে আমার কমিউনিটিকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা। এর বাইরেও অনেক কাজ আছে। যেমন আমার সম্প্রদায়ের কোনো লোক নির্যাতিত, নিষ্পেষিত হলে, আমাদের কারো জমি বা ভূমি দখল হলে, বাড়ি ভাংচুর হলে আমাকে সেখানে যেতে হয়, এও দেখতে হয়। আমার কমিউনিটির মানুষের সার্বিকভাবে কল্যাণের জন্য, তাদের নিরাপত্তা প্রদানের সব কাজই করতে হয়।
আর কোনো কার্যক্রম?
এর বাইরে আমাদের মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি ‘সম্প্রীতি কার্যক্রম’ আছে। সম্প্রীতি মানে হলো আমাদের আন্ত:ধর্মীয় সংলাপ ইত্যাদি প্রগ্রামগুলো ২০১৫ সালের পর থেকে আমরা অনেক জেলায় করেছি। আমি অবশ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে, মন্ত্রীর সঙ্গে থেকেও কয়েকটি জেলায় আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতি সংলাপ সম্পন্ন করেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমাদের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে, বিশেষত পালক, পুরোহিতদের সঙ্গে ঢাকার কেআইবি (কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ)’তে ২০১৫ সালের এপ্রিলে বিশাল আয়োজনে সম্পন্ন করেছি। ১৫শ মোট আলেম-ওলামা, পুরোহিত, ভিক্ষু, ফাদার, ব্রাদার, সিস্টার ছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুষ্ঠানটির প্রধান অতিথি ছিলেন। তিনি তখন বলেছেন, ‘আসলে পুলিশী ব্যবস্থা দ্বারা আসলে তো সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ এককভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না। ফলে মানুষের সম্প্রীতি প্রচারের জন্য ধর্মীয় নেতাদের কথা মানুষ অনেক শোনে বলে রিলিজিয়াসলি বা ধর্মের আলোকে তাদের বক্তব্য বা বয়ান প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।’ অনুষ্ঠানে শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ সাহেব ছিলেন। আমাদের কার্ডিনাল মহোদয়-ফাদার প্যাট্রিক ডি রোজারিও সিএসই ছিলেন। তখন আমাদের বৌদ্ধদের প্রধান ছিলেন শুদ্ধানন্দ মহাথেরো। দুর্বেশানন্দ স্বামীজি ছিলেন। প্রতিটি ধর্মের প্রধান ধর্মগুরুরা ছিলেন। আমাদের সম্প্রীতি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিটি জেলায় আমরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এটি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প আসলে। মনে করেন, মন্ত্রণালয় একটি প্রগ্রাম নেবে রাজশাহীতে, একটি আন্ত:ধর্মীয় সংলাপ হবে। আমি খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব হিসেবে ওখানে আমাদের যারা ফাদার, ব্রাদাররা আছেন তাদেরকে সেখানে ট্যাগ করে দেওয়া; আমাদের লিডারদের উপস্থিতি-সেটি করি। আমাদের মন্ত্রী চট্টগ্রাম গিয়েছেন, আমাকেও যেতে হয়েছে। সেখানে আর্চবিশপ আছেন। ফাদাররা আছেন, তাদের সঙ্গে বসে আমাকে অগানাইজ করতে হয়েছে। এমনই মানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুষ্ঠানগুলো। এগুলো আন্ত:ধর্মীয় সংলাপ বা সম্প্রীতি সমাবেশ ইত্যাদি। এই কাজগুলো করতে হয়।
খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের কাঠামো কেমন হবে?
আমাদের এখানে এখন সাতজন কর্মী-কর্মকর্তা, কর্মচারী আছেন। কিন্তু আমরা মন্ত্রণালয়ের কাছে ৮০টি শূন্য পদ স্থায়ীভাবে তৈরির জন্য জমা দিয়েছি। আমাদের প্রধান কার্যালয়ে ২৪ জন থাকবেন। প্রধান কার্যালয় তৈরি হবে। আমাদের আটটি বিভাগের প্রতিটিতে একটি করে স্থায়ী অফিস থাকবে। মোট সাতজন করে মোট ৫৬ জন থাকবেন। এই মোট ৮০ জন। ট্রাস্টি বোর্ড অনুমোদনের পর এখন মন্ত্রণালয়ে গিয়েছে। একটি পজিশন সেখানে নকল আছে। ফলে সেটি বাদ দিয়ে মন্ত্রণালয় সদয় বিবেচনার পর ৮৯টি স্থায়ী পদ সৃষ্টি করেছে। এখন আমাদের জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আমাদের ফাইল যাবে। তারপর অথ মন্ত্রণালয়ের ক্লিয়ারেন্স পেলে আমাদের ফাইল পাশ হবে। ফলে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের স্থায়ী অফিসের মাধ্যমে আমাদের লোকেরা যেন সহজে ও ভালোভাবে উন্নত মানের সেবাগুলো লাভ করতে পারেন-এই আমাদের লক্ষ্য। এখন আমাদের এখানে ভবিষ্যতে একটি ডাটাবেইজ হবে। এজন্য ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রজেক্ট আমরা জমা দিয়েছি। হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট-সবাই জমা দিয়েছেন। একটি করে সফটওয়্যারে রাখা হবে। এর মাধ্যমে আমাদের কাজগুলো সম্পন্ন করবো। আমাদের চার্চের নাম, সেটির অবস্থান, প্রতিষ্ঠা, বর্তমান অবস্থা, সেই ফাদারের ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর সব তৈরি করা হবে। সেভাবে হিন্দু মন্দির, বৌদ্ধবিহার আলাদা ডাটাবেইজে থাকবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন মসজিদের অলাদা ডাটাবেইজ তৈরির জন্য কাজ করছে। শিখদের মোট পাঁচটি উপাসনালয় আছে। এই একটি বড় কাজ হচ্ছে।
আর?
আমাদের একটি পেমেন্ট সিস্টেম তৈরি হচ্ছে। আপনি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আবেদন করবেন, পেমেন্টের জন্য বসে থাকবেন, চেক ইস্যু হবে। না, আপনার প্রতিষ্ঠানের নাম থাকবে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকবে। ফলে অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হবে। আগে তো মসজিদে চেক ইস্যু হবে, ক্রস চেকে দেওয়া হবে-এমন একটি ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এখন সমস্ত টাকা অনুদানের জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। এই কার্যক্রমকে আমরা ‘ইএফটি-ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার সিস্টেম’ বলি। এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই বছরই এভাবে আমাদের মসজিদ, মন্দির, গির্জা, বিহারে অনুদান দেওয়া হয়েছে। আমাদের গির্জাগুলোরও এই ব্যবস্থায় এখন আসবে। আমরা এই ব্যবস্থাপনায় যাচ্ছি, যেন আমাদের কারো কোনো লোকের যেন আর কোনো ধরণের হয়রানি বা অবহেলার শিকার হতে না হয়। কারো যেন কষ্ট না নয়।
এই ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করবে?
আবেদন করার জন্য আপনার এখানে আসার দরকার নেই। আপনি অনলাইনে আপনার প্রতিষ্ঠান থেকেই কম্পিউটারের মাধ্যমে করবেন। যেমন আমাদের ফরম আমাদের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে নিতে হবে। এখানে আসতে হয় না। বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো ধর্ম এবং ধর্মের সঙ্গে যুক্ত কোনো খ্রিস্টান ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন তাদের আর্থিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাজে যদি আবেদন করতে চান, আমাদের ফরম ডাউনলোড করে ই-মেইল, কুরিয়ার বা ডাকে পাঠাবেন। এরপর আমরা যাচাই করে তাদেরকে আসতে বলবো। তারা এসে ক্রস চেক নিয়ে যাবেন। এটিও থাকবে না। আমাদের মসজিদগুলোর জন্য যে সিস্টেম ডেভেলপ করা হয়েছে, তাদের আসতে হয় না। আমরাও ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেব (দু:খিত হয়ে)। এই ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে।
এত কাজ কেন করবেন এবং করছেন?
আমাদের স্বপ্ন-আগামী দিনে বাংলাদেশের সব মানুষের যেন ধর্ম যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করতে পারেন। আমরা একটি শান্তিপূর্ণ, সম্প্রীতির বাংলাদেশ চাই। আমরা দেশে সব ধর্মের মানুষের সঙ্গে থেকে একটি সম্প্রীতিতে পূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। ধর্ম মন্ত্রণালয়েও এই হলো ভিশন ও মিশন-মানুষের ধর্মীয় এবং জীবনের উন্নয়ন। আমাদের খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টে লেখা আছে। বলি-আমাদের অ্যানুয়াল পারফরমেন্স এগ্রিমেন্টে আছে। আমাদের চার্চের পক্ষ থেকে তারা চাননি, কিন্তু তাদের সকল কাজই কিন্তু আমি করি। বঙ্গভবন, গণভবন, সচিবালয়, মন্ত্রণালয় সবখানে আমিই কাজ করি। প্রতিটি কাজই আমাকে করতে হয়। কিছুদিন আগে আমাদের অনুদান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন গির্জার অনুদান সংগ্রহ কাজও আমাকে করতে হয়েছে। সমস্ত কাজই করতে হয়। তখন কার্ডিনাল ফাদার প্যাট্রিক ডি রোজারিও, আমি আর ফাদার ডেভিড এগিয়ে করে এই কাজটি করেছি। আগে আমাদের চার্চের প্রধান কার্ডিনাল মহোদয় ছিলেন, এখন আর্চবিশপ মহোদয় আছেন। তাদের সঙ্গে তাদের জন্যই মূলত আমি কাজ করি। আমার কমকাণ্ডের মধ্যে তাদের জন্যই বেশি কাজ করতে হয়।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আপনাদের মিশন ও ভিশন?
আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ভিশন ও মিশনের মধ্যে আছে। আমাদের কল্যাণ ট্রাস্টের রূপকল্প বা ভিশন হলো-ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সম্পন্ন খ্রিস্টান সমাজ গড়ে তোলা। আর আমাদের মিশন হলো, দেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কল্যাণে, খ্রিস্টান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার, পরিচালনা, মেরামত ও উন্নয়নে সহায়তা প্রদান। ধর্মীয় উৎসব আয়োজন, উদযাপন এবং নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষা সম্পসারণের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুদৃঢ়করণ।
ছবি : খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্যসচিব নির্মল রোজারিও, বিশ্বের প্রথম বাঙালি কার্ডিনাল ফাদার প্যাট্রিক ডি. রোজারিও, শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ এবং খ্রিস্টানদের বাংলাদেশে পরিচালিত বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নটর ডেম কলেজ, ঢাকা।
(১৮ জুলাই, ২০২২, ঢাকা কারওয়ানবাজারের খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের অস্থায়ী কার্যালয়।)