আমাদের জীবনে নদী
এস. এম. আল ফাহাদ
নদী মানেই সভ্যতা, নদী মানেই সংযোগ। নদীই এদেশের সংস্কৃতি বিনির্মাণ করেছে, জনপদ তৈরি করেছে ও খাদ্য যুগিয়েছে। নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক অতি নিবিড়। এ নদীগুলোই হারিয়ে যেতে বসেছে। আমাদের নিভু, নিভু এই প্রাণগুলো নিয়ে কোনোরকমে বেঁচে থাকা চলছে। নদীগুলোকে নিয়ে পরিবেশবাদী, সাধারণ মানুষের যত উদ্বেগ। নদী রক্ষার তৎপরতা সারা পৃথিবী জুড়েই দৃশ্যমান। নদী সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ও ভাবনা তৈরি করতে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রবিবার পালন করা হয় ‘বিশ্ব নদী দিবস’।
এবারের নদী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো -"আমাদের জনজীবনে নৌপথ।"
২৫ সেপ্টেম্বর (রবিবার) পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে, ইসাবেলা ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের সহযোগিতায় শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র ও কালীগঙ্গার মোহনায় ধাঁধারচরে (মাঝের চর) বিশ্ব নদী দিবস-২০২২ পালিত হয়েছে।
প্রধান অতিথি হিসেবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উদ্যোগে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালেদ মাহমুদ চৌধুরী, এমপি।
বিশেষ অতিথি ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব এম. মোস্তফা কামাল জাতিসংঘের রেসিডেন্ট প্রতিনিধি মিজ গোয়েন লুইস।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অধিবেশনে মুখ্য আলোচক ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস প্রফেসর ও প্রখ্যাত নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত।
আলোচক ছিলেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আনসারুল করিম ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান।
সভাপতি ছিলেন ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী, চেয়ারম্যান-জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ।
আমাদের নদীগুলোর সঙ্গে বাঙালির সারা জীবনের সম্পর্ক। গ্রামের পাশে বহমান স্রোতস্বিনী নদী, চলমান নৌকা, জেলেদের কর্মব্যস্ততা, পাড়ে শিশুদের দুরন্তপনা-বাংলার চিরায়ত রূপ। এসব নয়নাভিরাম দৃশ্যই শুধু নয়, নদী ও গ্রামকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে সমৃদ্ধ করেছে। শিরা, উপশিরার মত ছড়িয়ে, ছিটিয়ে থাকা নদীগুলোর কারণে বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত।
সারা বছর কম-বেশি জলপ্রবাহ থাকায় নদীগুলো হয়ে ওঠেছে লক্ষ প্রাণের এক, একটি গতিময় অভয়ারণ্য।
এই আধারগুলো মিঠাপানির। অসংখ্য ক্ষুদ্র অমেরুদন্ডী প্রাণী, আমাদের বেঁচে থাকার খাবার ও জীবিকা মাছ, উভচর প্রাণী, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী; কত, শত প্রাণের আবাসস্থল।
আমাদের মিঠাপানির মৎস্যসম্পদের প্রধান উৎস নদীগুলো। ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২শ ৬০টি প্রজাতির দেশী মাছ পাওয়া যায় বাংলাদেশের নদীগুলোতে। খাদ্যের সন্ধানে তীর ও জেগে ওঠা চরে এসে ভীড় করে বক, পানকৌড়িসহ নানা জাতের পাখি।
দেখা যায় তার বুকে স্তন্যপায়ী শুশুক, ভোঁদড়। নদীতে শামুক, ঝিনুক মেলে।
মাছ হিসেবে খাদ্য কাকঁড়া, চিংড়ির অমেরুদন্ডী প্রাণী। আরও কত যে আছে। এসব প্রাণীর উপর নির্ভরশীল হয়ে বাঁচে পাখিসহ অন্যান্য প্রাণীরা।
নদী ভরাট ও দূষণে মাছসহ অন্যান্য জীবের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ মরে যাচ্ছে। নদীতে চর পড়ে যাওয়ায় মাছের উৎপাদন কমছে। ইতোমধ্যেই নদীগুলো হতে অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়েছে, অনেক মাছ বিলুপ্তির প্রহর গুনছে। সাথে, সাথে নির্ভরশীল অন্যান্য প্রাণীকুল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রভাব পড়ছে সমগ্র প্রতিবেশে, বাস্তুসংস্থানের ওপর। ফলে আমাদের নদীগুলো সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
সবার আগে নদী ভরাট করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অবৈধ বালু উত্তোলন, নিষিদ্ধ কারেন্ট ও চায়না-দুয়ারি জাল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। নদীর গতিপথ ও নাব্যতা ঠিক রাখতে হবে। নদীর সাথে বিল, খাল, জলাধারের সংযোগ স্থাপন করে মাছের স্বাভাবিক বিচরণ নিশ্চিত করতে হবে।
আশার কথা, সম্প্রতি হাই কোর্ট নদীকে জীবন্ত সত্তা রায় দিয়েছেন। ফলে নদী আর ময়লা ফেলার ভাগাড় নয়। পানির অপর নাম জীবন আর নদী এই জীবনের গতিময় ধারা। নদীর বাঁচা, মরার ওপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভর করে। সুস্থ প্রকৃতির জন্যই নদী সংরক্ষণ করতে হবে। ‘বাঁচলে নদী বাঁচবে দেশ, বাঁচবে প্রিয় বাংলাদেশ।’
লেখক: প্রেসিডেন্ট, রিভার ডিফেন্ডার্স ক্লাব। শিক্ষার্থী, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ওএফএস।