বাকের খনির প্রেমের সৃষ্টি বাকরখানি!
ইতিহাসের নানান স্থাপনা ও বাহারি খাবারের জন্য ৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে জনপ্রিয় পুরান ঢাকা। বিভিন্ন স্থাপনা যেমন দাঁড়িয়ে রয়েছে কালের সাক্ষী হয়ে তেমনি নানান মুখরোচক খাবার ধরে রেখেছে ঐতিহ্য। পুরান ঢাকার বাহারি সব খাবারের মধ্যে অন্যতম বাকরখনি। সকাল কিংবা বিকেলের নাস্তায় পুরান ঢাকার লোকদের বিশেষ পছন্দ এই বাকরখানি। সঙ্গে চা হলে যেন আর কথাই নেই।
বিস্কুটের মতো দেখতে খাজ কাটা এক ধরনের গোল খাবারের নাম বাকরখনি। বাকরখানি ময়দা দিয়ে তৈরি করা হয়। ময়দার খামির থেকে রুটি বানিয়ে তা মচমচে বা খাস্তা করে মাটির চুলোয় ভেজে বাকরখানি তৈরি করা হয়।
জনশ্রুতি অনুসারে, জমিদার আগা বাকের তথা আগা বাকির খাঁর নামানুসারে এই খাবারের নামকরণ করা হয়েছে।
বাকরখানির ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর দত্তক ছেলে আগা বাকের। প্রখর মেধার অধিকারী আগা বাকের যুদ্ধবিদ্যাতেও পারদর্শী ছিলেন। রাজধানী মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগম ও আগা বাকের পরস্পরের প্রেমে পড়েন। কিন্তু উজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খান ছিলেন পথের কাঁটা, তিনি খনি বেগমকে প্রেম নিবেদন করলে তিনি জয়নাল খানকে প্রত্যাখান করেন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে জয়নাল খনি বেগমের ক্ষতির চেষ্টা করেন এবং খবর পেয়ে বাকের সেখানে যান ও তলোয়ারবাজিতে জয়নালকে হারিয়ে দেন। অন্যদিকে জয়নালের দুই বন্ধু উজিরকে মিথ্যা খবর দেন যে, বাকের জয়নালকে হত্যা করে মরদেহ গুম করেছে। উজির ছেলের হত্যার বিচার চায়। নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ পুত্র বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। অবশেষে বাকেরের হাতে মারা যায় বাঘ। ইতোমধ্যে জয়নালের মৃত্যুর মিথ্যা খবর ফাঁস হয়ে গেছে। এ ছাড়া জোর করে খনি বেগমকে দক্ষিণ বঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও খবর রটে। খনি বেগমকে উদ্ধার করতে যান বাকের। পিছু নেন উজির জাহান্দার খান। জয়নাল খনি বেগমকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করেন। বাকেরগঞ্জে সমাধিস্থ করা হয় খনি বেগমকে। আর বাকের সবকিছু ত্যাগ করে রয়ে গেলেন প্রিয়তমার সমাধির কাছে – দক্ষিণ বঙ্গে। বাকের খাঁর নামানুসারেই বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ (পটুয়াখালি-বরিশাল) অঞ্চলের নাম হয় বাকেরগঞ্জ।
অপর একটি মত অনুযায়ী, মির্জা আগা বাকের ঢাকায় বাকরখানি রুটি প্রচলন করেন। তিনি বৃহত্তর বরিশালের জায়গীরদার ছিলেন। তার প্রেয়সী ছিল আরামবাগের নর্তকী খনি বেগম। তাদের মধ্যে গভীর প্রেম ছিল বলে জনশ্রুতি ছিল। পরবর্তীতে আগা বাকের দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি খাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন। কিন্তু খনি বেগমের স্মৃতি তিনি ভুলে যাননি। তার আবিষ্কৃত এবং প্রিয় খাদ্য বিশেষভাবে তৈরি রুটির নাম তার প্রেমকাহিনীর উপর ভিত্তি করেই নামকরণ করা হয়েছিল বাকের-খনি রুটি। পরবর্তীতে এই নাম কিছুটা অপভ্রংশ হয়ে বাকরখানি নাম ধারণ করে।
উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে প্রকাশিত হাকিম হাবিবুর রহমান তার “Dhaka Pachash Barash Pahley” গ্রন্থে ঢাকার বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের তৈরি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি প্রধানত গও জোবান, শুকি ও নিমশুকি তিন ধরনের বাকরখানির কথা বলেন।
জনশ্রুতি মেনে নিলে ধরে নিতে হয়, বাকরখানির সৃষ্টি আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। অনেকে আবার ধারণা করেন, সিলেট জেলায় সর্বপ্রথম বাকরখানি তৈরি হয় এবং অনেকে মনে করেন এটি চট্টগাম অঞ্চলের খাবার। পুরান ঢাকার নারিন্দা, লোহারপুল, গেন্ডারিয়া, নাজিরাবাজারসহ বিভিন্ন অলি-গলিতে এই খাবার পাওয়া যায়।
দোকানগুলিতে দুই ধরনের বাকরখনি পাওয়া যায়। মিষ্টি ও মিষ্টি ছাড়া। মিষ্টি বাকরখনির কেজি ১৮০-১৯০ টাকা এবং মিষ্টি ছাড়া বাকরখনির দাম ১৭০-১৮০ টাকা। পিস প্রতি বাকরখনির দাম ৭-৭ টাকা হয়ে থাকে।
বেশ কয়েকজন ক্রেতা জানায়, বাকরখনি খুব ভালো খাবার। অন্যান্য নাস্তা আইটেমে তেল থাকে কিন্তু বাকরখনিতে থাকে না তাই এটি ভালো। সকাল ও বিকেলের নাস্তায় বাকরখনিই তাদের জনপ্রিয়।
একরামপুর মোড়ের বাকরখনি বিক্রেতা সুমন জানান, এখন আর আগের মতো বিক্রি হয় না। খুব কম মানুষই কিনে। সবকিছুর দাম বাড়ছে তাই এসবের দামও বেড়েছে।
এসএন