অবিভক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রী নলিনীরঞ্জনের বাড়ি অবহেলিত
নজরদারি, সংস্কারের অভাব আর অবহেলায় পড়ে আছে নেত্রকোনায় অবিভক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রী প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ নলিনীরঞ্জনের পৈতৃক বাড়ি। ফলে শিকড়-বাকড় ও আগাছার দখলে অস্তিত্ব হারাচ্ছে দুই বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি। সাবেক জেলা প্রশাসক কাজি আব্দুর রহমান এটিকে তত্ত্বাবধানের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদন করলেও আলোর মুখ দেখেনি এখনো।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার চিরাং ইউনিয়নের সাজিউড়া গ্রামে ১৮৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি সনাতন ধর্মাবলম্বী এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে নলিনীরঞ্জন সরকার জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম চন্দ্রনাথ সরকার। ১১ ভাইবোনের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই নলিনীরঞ্জন সরকার ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও ডানপিটে স্বভাবের। লেখাপড়া শেষ না করেই ভাগ্য অন্বেষণে চলে যান সুদূর কলকাতায়।
কলকাতা শহরে রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে অল্প সময়ের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশ সরকারের শাসনামলে তরুণ বয়সেই তিনি কলকাতা সিটি কপোরেশনের প্রথম বাঙালি মেয়র হন। এ অঞ্চলের মানুষকে শিক্ষিত করার লক্ষ্যে ১৯০৯ সালে নেত্রকোনা শহরের মগড়া নদীর পাড়ে মালনী রোডে মনোরম পরিবেশে তার বাবার নামে চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তিনি অবিভক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পুনরায় পশ্চিমবঙ্গ বিধান রায়ের মন্ত্রিসভার অর্থ ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ভারত বিভক্তের পর নলিনীরঞ্জন সরকারের পুরো পরিবার জায়গা জমি রেখে ভারতে চলে যান। সেই থেকে তাদের ঘরবাড়ি সহায় সম্পত্তি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণ দিকে চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই ১১ নম্বর চিরাং ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি)। পরিষদ থেকে কিছুটা দূরেই সাজিউড়া গ্রাম। সেই গ্রামে প্রকৃতির সঙ্গে অনেকটা যুদ্ধ করে কালের সাক্ষী হিসেবে এখনও দাঁড়িয়ে আছে এককালের ঐতিহ্যবাহী নলিনী রঞ্জন সরকারের পৈতৃক বাড়ি। এক একর জমিতে অবস্থিত দ্বিতল ভবনের বাড়িটি অযত্নে, অবহেলা আর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে তার আগের জৌলুস হারিয়ে ফেলছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সবুজে ঘেরা বাড়ির মূল ফটকে রয়েছে বিশাল পুকুর, শানবাঁধানো ঘাট, নয়নাভিরাম বসত ঘরসহ বিভিন্ন দেবদেবীর মন্দির। বাড়ির দেয়াল ও ছাদ থেকে প্লাস্টার খসে পড়ছে। লতাপাতার শেকড়-বাকড়ে ক্রমশ বন্দি হয়ে বিলীন হতে চলেছে বাড়িটির অস্তিত্ব।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নলিনীরঞ্জন সরকারের পরিবারের রেখে যাওয়া কয়েক একর জায়গা জমি স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে গ্রামের বাসিন্দারা সেখানে বসবাস এবং তাদের জায়গা-জমি চাষাবাদ করে আসছেন। কেন্দুয়াসহ সচেতন নেত্রকোনাবাসীর প্রাণের দাবি, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে নলিনীরঞ্জন সরকারের পৈতৃক বাড়িটি যথাযথ সংস্কার ও সংরক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
নেত্রকোনা জেলা শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. নুরুল ইসলাম জানান, নলিনীরঞ্জনের পৈতৃক বাড়িটি শুধু আমাদের জেলা নয় সারা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে টিকানোর দায়িত্ব আমাদের ।এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
সংবাদকর্মী মো. রুকন উদ্দিন জানান, দুই বাংলার ঐতিহ্যবাহী অবিভক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রী প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ নলিনীরঞ্জনের পৈতৃক বাড়িটি আজ অবহেলিত। সরকারি তদারকি ছাড়া এর ঐতিহ্য ও সংস্কার কোনোটাই সম্ভব নয়। ভবনটি সংস্কার করে অবিভক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রীর কর্মকাণ্ড তুলে ধরলে বর্তমান প্রজন্ম তা জানতে পারত।
বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের জেলা আহ্বায়ক শামীম তালুকদার জানান, চলুন আমরা আমাদের বৃটিশ সরকারের আমলের ঐতিহাসিক তথ্য জানার জন্য নলিনীরঞ্জনের পৈতৃক বাড়ি উদ্ধারের পদক্ষেপ গ্রহণ করি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করি। যার যে মিডিয়া আছে লেখালেখি করি। তাহলে এ বাড়ির ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ার পথ তৈরি করা সম্ভব হবে।
জেলা উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অসিত কুমার ঘোষ জানান, নলিনীরঞ্জনের মতো এত বড় নেতা আমাদের জেলার কেন্দুয়া উপজেলার সাজিউড়া গ্ৰামে জন্ম নিয়েছিলেন তা জানতাম না। জেনে খুব খুশি হয়েছি। এর ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব একদিকে যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি অন্যদিকে সচেতন মহলের।
জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানান, আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি। এ বাড়ি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বাড়ি। যার সঙ্গে অতীতের রাজনীতি ও সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে। জেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
এসএন