পাড়াগাঁয়ে ব্যতিক্রমী এক বিদ্যাপীঠ
প্রথমে দেখে মনে হবে এটি কোনো জমিদারের বাড়ি বা অভিজাত রিসোর্ট। বাংলাদেশে এমন দৃষ্টিনন্দন বিদ্যাপিঠ তেমন দেখা যায় না। যেখানে ব্যতিক্রম পরিবেশে শিক্ষা দেওয়া হয়। ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের চরভিটা গ্রামে অবস্থিত ব্যতিক্রম এ বিদ্যাপিঠ। নাম ‘চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যাল‘। এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের আধুনিক সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান করা হয়।
ভারত সংলগ্ন বর্ডারের প্রায় দুই কিলোমিটার আগে দেখা মিলল দৃষ্টিনন্দন একটি বিদ্যাপিঠের।সূর্যের আলোয় বিদ্যাপিঠটি ঝলমল করছে। রাতের জন্য রয়েছে ল্যাম্পশেডও।
২০০১ সালে এরফান আলীর (প্রধান শিক্ষক) বাবা নুরুল ইসলাম নিজ জমিতে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়টির সরকারিকরণ করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয় ভবনের চারপাশ খোলামেলা। শ্রেণিকক্ষসহ বিদ্যালয়ের সবকিছুই রঙিন প্রচ্ছদে ঢাকা। বালক-বালিকাদের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা শৌচাগার, খেলাধুলার জন্য রয়েছে নানান ধরনের সরঞ্জাম। বিদ্যালয়টিতে রয়েছে কারুকার্যখচিত, সুসজ্জিত নান্দনিক ভবন। দ্বিতল ভবনের ছাদে দেওয়া হয়েছে বিদ্যালয়ের নিজ অর্থায়নে কম্পিউটার ল্যাব। ভবনের উত্তরে হাঁস-মুরগির খামার ও বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব লাইব্রেরি এবং পশ্চিম পাশে রয়েছে সিসি ক্যামেরায় মনিটরিং রুম, সততা ক্যান্টিন, মসজিদ, মাছ চাষের পুকুর।
শিক্ষার্থীদের বিনোদনের জন্য রয়েছে শিশুপার্ক ও মিনি চিড়িয়াখানা। খেলার মাঠের এক পাশে আছে দোলনা, গরুর গাড়ি। পুকুরে নৌকা। দেয়ালে আঁকা রয়েছে স্বাধীনতার মহান পুরুষ ও শহীদদের প্রতিকৃতি, কবি-সাহিত্যিকদের ছবি। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর ছবি। মাটিতে ফুলের গাছ দিয়ে বানানো হয়েছে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও বৃত্ত।
চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিজ জমিতে সবজি চাষ করা হয়। তাদের ফলানো সবজি ব্যবহার হয় মিড-ডে মিলে। তা ছাড়া, বিনামূল্যে শেখানো হয় কম্পিউটার, আবৃত্তি, অভিনয়। ভারতের সীমান্তঘেঁষা এ স্কুলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৫০। চারজন শিক্ষক ও তিনজন প্যারাশিক্ষক রয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা জানায়, বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ফাঁকে তারা প্রতিদিন একদল খাবার দেয় হাঁস-মুরগিকে, অন্য দল সবজি বাগানের পরিচর্যা করে। এ কাজ করতে ওদের ভালো লাগে। স্কুলের খাবার খেয়ে তারা এখন নিশ্চিন্তে পড়ালেখা করতে পারছে। সমাপনী পরীক্ষার পর স্কুল ছেড়ে চলে যাবে কেউ কেউ। স্কুলের জন্য ভালো কিছু একটা করে যেতে পারলে নিজেরও ভালো লাগবে।
অভিভাবকরা জানান, এখন বাচ্চারা বাড়ির খাবারের থেকে মিড-ডে মিল খেতে বেশি আগ্রহী। ছেলে-মেয়েরা যে চাষাবাদ ও অনেক কিছু শিখছে, তাতে তারা খুশি।
চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলী বলেন, অভাব-অনটনের কারণে অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে খুব একটা হাজির হতো না। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়ে ১৫০ শিক্ষার্থী ছিল, কিন্তু প্রতিদিন হাজির থাকত ৬০ থেকে ৭০ জন। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা এবং ঝরে পড়া রোধে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করে পড়ালেখায় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতে বিদ্যালয়ে ‘মিড ডে মিল চালুর ব্যবস্থা করি।
তিনি আরও বলেন, প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। এ উদ্যোগ চালু রাখতে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম নিজের ৬ বিঘার একটি পুকুর ও ২ বিঘা জমি বিদ্যালয়কে ব্যবহার করতে দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি প্রতি মাসের লবণ ও তেলের জোগান দেন। সেই পুকুরেই চলছে মাছ চাষ, হাঁস-মুরগির খামার, জমিতে সবজি। ‘মিড ডে মিল’ চালু করায় স্কুলে শিক্ষার্থী বাড়ছে, সেই সুবাদে তিনি মনে করেন তার স্কুল এখন সেরা।
হরিপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আজিজার রহমান বলেন, চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হরিপুর উপজেলার অন্যতম একটি বিদ্যালয়। এখানে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সৃজনশীল অনেক কিছু জিনিস আছে যা শিক্ষার্থীদের মনকে দোলা দেয়। বিদ্যালয়টি দিন দিন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, এলাকাবাসী সম্পৃক্ত হচ্ছে।
এসএন