ভুট্টাগাছ-নেপিয়ার ঘাস থেকে গুড়
পিঠা-পায়েস থেকে শুরু করে মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরিতে সাধারণত গুড়ের ব্যবহার হয়। এক্ষেত্রে আখের গুড় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হলেও বিশেষ সময় বা খাবারের ক্ষেত্রে খেজুর গুড়ের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। আবার কোনো কোনো এলাকায় তালে গুড়ের ব্যবহারও রয়েছে। তবে রংপুরের পীরগঞ্জে ভুট্টাগাছ ও নেপিয়ার ঘাস থেকে তৈরি গুড় সাড়া ফেলেছে।
রংপুরের পীরগঞ্জে ভুট্টাগাছ ও নেপিয়ার ঘাসের ডাটা থেকে গুড় তৈরি করেছেন এক কৃষক মোহাম্মদ আলী ভুট্টু। নতুন এ গুড়ের স্বাদে তৃপ্ত এলাকাবাসী। সবাইকে তাক লাগিয়ে পরিত্যক্ত ভুট্টাগাছ আর নেপিয়ার ঘাস মাড়াই করা রসে গুড় তৈরি করেছেন তিনি। এরই মধ্যে তার উদ্ভাবিত এ গুড় সাড়া ফেলেছে গ্রামে। কৃষক মোহাম্মদ আলী ভুট্টু তার তৈরি গুড় বাজারজাত করার জন্য প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন। তবে প্রশাসন বলছে, বিএসটিআইয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এ খাদ্য দ্রব্য নিয়ে কোনো মতামত দেওয়া যাচ্ছে না। যেহেতু এটা গবাদি পশুর খাদ্য তা মানুষ খেলে যকৃতে অস্বাভাবিক প্রভাব পড়তে পারে।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার চৈত্রকোল ইউনিয়নের ঝাড়বিশলা গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মোহাম্মদ আলী ভুট্টু। প্রায় এক বছর ধরে তিনি বাড়ির পাশের একটি গরু খামারে কাজ করছেন। সেখানে নিয়মিত নেপিয়ার ঘাস ও ভুট্টাগাছ মেশিনে কেটে খামারের গরুকে খাওয়ান। দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ ব্যতিক্রম চিন্তা মাথায় চেপে বসে কৃষক ভুট্টুর। তিনি ভুট্টাগাছ ও নেপিয়ার ঘাসের পাতা ও কাণ্ড মাড়াই করেন। সেই মাড়াই করা রস চুলায় জ্বাল করে মাড়াই করা রস জমাট বেঁধে তৈরি হয় গুড়।
একইভাবে আরেক দফায় আরও বেশি করে ঘাসের ডাটা ও ভুট্টাগাছ অন্যের আখ মেশিনে মাড়াই থেকে রস দিয়ে গুড় তৈরি করেন। ভুট্টাগাছ থেকে ভুট্টুর গুড় তৈরি দেখতে কৌতুহলী গ্রামবাসী তার বাড়িতে ভিড় করছেন। অনেকেই নতুন স্বাদের সেই গুড় খেয়ে পরিতৃপ্তির কথা বলেছেন। গুড়ের নতুন এ উদ্ভাবন নিয়ে আনন্দিত কৃষক মোহাম্মদ আলী ভুট্টু। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা মিললে ভুট্টাগাছ ও ঘাসের গুড়ে নিজের পাশাপাশি এলাকার অনেকের জীবন বদলে দিতে চান এই দরিদ্র এ কৃষক। একই সঙ্গে বাজারজাতকরণেও চাইছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তা।
কৃষক মোহাম্মদ আলী ভুট্টু বলেন, আমি এক বছর ধরে গরুর খামারে কাজ করি। সেখানে ভুট্টাগাছ-ঘাস কেটে কেটে গরুকে খাওয়াতে হয়। কিন্তু গরুতো ভুট্টাগাছের ডাটা খায় না। আমি কয়েকদিন ওই ডাটা কেটে কেটে দাঁতে চিবিয়ে দেখেছি। ভুট্টাগাছের রস মিষ্টি লাগত। তখনই ভাবতে থাকি, আখ থেকে যদি গুড় হয়, তাহলে ভুট্টা থেকে হবে না কেন? এরপর ভুট্টার গাছসহ নেপিয়ার ঘাস গাছ মাড়াই করে রস থেকে গুড় তৈরির বিষয়টি মাথায় আসে।
তিনি বলেন, আমার বাড়ির পাশে আখ মাড়াই করা মেশিন আছে। সেখান থেকে মাড়াই করে রস সংগ্রহ করি। এরপর সেটা হাড়িতে একটু জ্বাল করেছি। এসময় রস জমাট বেধে একদম গুড়ের মতো হয়। আমি সেটা গ্রামের অনেক লোকজনকে খেতে দিয়েছি। সবাই আমার তৈরি গুড় খেয়ে খুশি হয়েছে।
পীরগঞ্জ উপজেলার চৈত্রকোল ইউনিয়নের ঝাড়বিশলা গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় গ্রামবাসী বলছেন, নতুন এ গুড় মিষ্টি ও অভিন্ন স্বাদযুক্ত। ছোটবড় সব বয়সী মানুষ এ গুড়ের স্বাদ নিয়েছেন। এ গুড় খেয়ে এখন পর্যন্ত কারো কোনো সমস্যা হয়নি।
উপজেলার চৈত্রকোল ইউনিয়নের ঝাড়বিশলা গ্রামের বাসিন্দা জনৈক হামজা বলেন, আমি দুই দিন ওই গুড় তৈরি করা দেখেছি। পরে অন্যদের মতো আমি নিজেও খেয়ে দেখেছি। আখ, তাল, খেজুরের গুড়ের মতো স্বাদ আমি ভুট্টা গাছের গুড়ে একই স্বাদ পেয়েছি। নতুন এ গুড় অনেকেই খেয়েছেন কারো কোনো শারীরিক সমস্য দেখা দেয়নি।
পীরগঞ্জ উপজেলার চৈত্রকোল ইউনিয়নপরিষদ চেয়ারম্যান আরিফুজ্জামান শাহ নতুন উপকরণে গুড় তৈরির উদ্যোগের প্রশংসা করছেন। তিনি বলেন, ভুট্টুর এমন উদ্যোগ সবাইকে অবাক করেছে। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি। পরিত্যক্ত ঘাসের ডাটা ও ভুট্টাগাছ থেকে তৈরি করা গুড় আমার খুব ভালো লেগেছে।
রংপুরের (পীরগঞ্জ) বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এর আঞ্চলিক প্রধান কৃষিবিদ ড. মো. ছাদেকুল ইসলাম বলেছেন, উদ্যোগটি খুবই ভালো। এটি নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। তবে ভুট্টাগাছ ও নেপিয়ার ঘাস যেহেতু ফোডার ক্রপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেখান থেকে গুড় তৈরি হওয়াতে এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার রয়েছে। ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে মানুষের মানবদেহে বা স্বাস্থ্যের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ কি না আগে সেটা নিশ্চিত হতে হবে।
রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. শামিম আহম্মেদ বলেছেন, বিএসটিআইয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এ খাদ্য দ্রব্য নিয়ে কোনো প্রকারের মতামত দেওয়া যাচ্ছে না। যেহেতু এটা গবাদি পশুর খাদ্য তা মানুষ খেলে যকৃতে অস্বাভাবিক প্রভাব পড়তে পারে। গুড় উৎপাদনকারী কৃষক মোহাম্মদ আলী ভুট্টুর গুড় বাজার জাতের প্রশ্নেই আসে না। কারণ এটি হচ্ছে গো-খাদ্য মানব দেহে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা বিএসটিআইকে নিয়ে একটি টিম গঠন করেছি যেকোনো সময় কৃষক মোহাম্মদ আলী ভুট্টুর গুড় তৈরি পর্যবেক্ষণ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসএন