‘মামা, চাচা থাকলে আরো আগেই রুবেল জাতীয় দলে চান্স পেত’
ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ে ১৯৯৯-২০০০ শিক্ষাবর্ষের ভতি হবার পর থেকে আজীবনের বন্ধু তারা। মোশাররফ রুবেল বাংলাদেশের স্পিনার। জাতীয় দল, লিগগুলোতে খেলেছেন। তাকে নিয়ে বলেছেন ষষ্ঠ ব্যাচের বন্ধু, ক্রিকেটার, আইইআর অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক নুরুল হায়াত টুটুল
তারকা স্পিনার মোশাররফ রুবেল কীভাবে আইইআরে এলো?
মোশাররফ রুবেলের আসল নাম কিন্তু খন্দকার মোশাররফ হোসেন রুবেল। আমাদের ১৯৯৯-২০০০ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইআর) ভর্তি হয়েছিল। সে বিকেএসপির ছাত্র ছিল, ফলে খেলোয়াড় কোঠায় এসেছে। যেহেতু কোঠাগুলোতে ভর্তি বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ, নিয়মিত ছাত্র, ছাত্রীদের একটু পরেই করা হয়, ফলে ও এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের আরেক ফুটবলার মাসুদ খান জনি দুজন কোঠায় আমাদের ব্যাচে পড়তে এলো।
তোর সঙ্গে পরিচয়?
রুবেলের সঙ্গে আমার পরিচয় আইইআরের ক্যান্টিনের সামনে, এই বিখ্যাত ডায়াসে। ভর্তি হবার পর ও কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল। তার হল ‘সূর্যসেন’। হলে ওঠা আসলেই খুব জরুরী ছিল ওর জন্য। কেননা কিশোরগঞ্জের ছেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে কিন্তু হলে কীভাবে উঠবে? তার একটি ধারণা ছিল, এজন্য পলিটিক্যাল লিংক লাগে, নেতাদের পেছনে সময় দিতে হয়। মধুর ক্যান্টিনে যেতে হয়। যেহেতু খেলাকে পছন্দ করে, ক্যারিয়ার হিসেবেও নিয়েছে, ফলে রুবেল খেলা ফেলে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত হতে পারবে না কিন্তু হলে তো তার উঠতে হবে। ক্লাস, পড়ালেখা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন যে কাটাতে হবে। এই বিষয়গুলো নিয়েই কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়েছিল। তখন-আমি, আমাদের ব্যাচের ছাত্র, ঘনিষ্ট বন্ধু জিন্নাহ (জহিরুল ইসলাম) এবং অঞ্জন (অঞ্জন দেবনাথ)-আমাদের সঙ্গে তার পরিচয় হলো। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে তোর? বললো, ‘বন্ধু, আমার সূর্যসেন হলে অ্যাটাচমেন্ট আছে। আমাকে হলে উঠতে হবে কিন্তু উঠতে পারছি না।’ পরে আমি বললাম, ‘এ নিয়ে টেনশনের কিছু নেই। তুমি যদি সূর্যসেন হলের হয়ে থাকো, তাহলে আজকে নাকি আগামীকাল উঠবে, সেটি তোমার সমস্যা। আমার কাছে এ কোনো সমস্যা নয়। আমার তো রুম আছে। সেখানে যেকোনো সময় উঠতে পারবে।’ কথাটির পর খুব অবাক হয়ে গেল রুবেল। মানে সে হলে উঠতে পারছে না কোনো চেষ্টাতেই আর এখন একদিনের মধ্যে উঠবে, আমি সুযোগ করে দিয়েছি, এজন্য অদ্ভুভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। ফলে বললাম, ‘বন্ধু এটি কোনো সমস্যা নয়, তুমি হলে ওঠো। যেহেতু তোমার সমস্যা আছে। আসো।’ তখন সূর্যসেন হলের ৫৪৯ নম্বরে আমার রুমে উঠলো। আমি আর রুবেল ছিলাম বেডমেট। একই বেডে তখন থেকে বাকি হলজীবন আমরা থেকেছি।
মানুষ হিসেবে কেমন ছিল? কেননা, রুমমেট কেমন সেটি সবচেয়ে ভালো বোঝেন আরেক বেডমেট।
মানুষ হিসেবে বলতে গেলে-রুবেল, আসলে বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে যদি তুলনা করি-তাহলে বলতে হবে, সে ছিল খুবই সিম্পল। খুবই সাধারণ মানের একটি ছেলে। সেই সময় সে ঢাকার লীগে খেলছে, খেলার সঙ্গে পুরোপুরিভাবে জড়িয়ে আছে। এই যে অহমিকা ভাবটি ফ্রম দি বিগেনিং তার ভেতরে ছিল না। একদম সাদামাটা ছিল ও। ক্লাসে আসতো, ক্লাস করতো কিন্তু যদি বলেন ফ্যাশনেবল কী না? হ্যাঁ, অবভিয়াসলি। ফ্যাশন সম্পর্কে খুব সচেতন ছিল। এই বিষয়গুলোও তার ভেতরে ছিল। তবে অহমিকাবোধ বা এই ধরণের জিনিশগুলো তার ভেতরে কখনো কাজ করেনি।
কীভাবে সময় কাটতো তোদের প্রথম দিকে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাটার্নটিই যেরকম-ক্লাস শুরু হবে, আস্তে আস্তে বন্ধুত্বের দিকে যাবে। আসলে যেকোনো বিভাগের একটি সেশনে অনেক ছাত্র, ছাত্রী থাকে। আমাদের আইইআরে তো অনেকগুলো বিভাগ। ফলে ছাত্র, ছাত্রী বেশ। আমরা মোট ৯০ জন। সবাই নতুন ভর্তি হয়েছি। আমাদের ষষ্ঠ ব্যাচে ক্লাসমেট তো সবাই ছিল। তাদের মধ্যে গুটিকয়েক খুব ক্লোজলি মিশেছি। আমরা পাঁচজন, খুবই ক্লোজ-রুবেল, আমি, জিন্নাহ, অঞ্জন ও তুহিন। প্রত্যেকে এখন প্রতিষ্ঠিত। এই কজন তখন সার্বক্ষণিক, একসঙ্গে। হয় আমার রুমে, যেহেতু আমি আর রুবেল একসঙ্গে থাকি, একই রুমে; না হয় অঞ্জনের জগন্নাথ হলের রুমে। এভাবে আমাদের দিনরাতগুলো কেটেছে। খেলার সময় রুবেল চলে যেত মাঠে। এরপর আবার আমাদের সঙ্গে থাকত। সবকিছু আমরা একসাথে করতাম। খেলা নয় আড্ডা।
আইইআর ছাড়লো কেন?
যেহেতু খেলাধুলার প্রেশার ছিল তার খুব কিন্তু আইইআরের যে সিস্টেম, সেখানে পড়ালেখার চাপ আছে। এই সেমিস্টার সিস্টেমের সঙ্গে সে মানিয়ে নিতে পারছিল না। ফলে পরে মাইগ্রেট বা বিভাগ পরিবতন করে রুবেল হিস্ট্রিতে চলে গেল।
তার প্রথম ম্যাচ এখানে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু আন্তঃবিভাগ টুনামেন্ট হয়, একটি বিভাগের সঙ্গে আরেকটি বিভাগের খেলা হয়। যখন আইইআরে ছিল, প্রথম বর্ষে আমাদের যে ক্রিকেট টুর্নামেন্টটি হয়েছিল, সেখানে প্রথম বর্ষের প্রথম ম্যাচে ছাত্র হিসেবে তার পারফরমেন্স এখনো পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো, সেরা রেকর্ড ও কীর্তি হিসেবে রয়ে গিয়েছে ২৩ বছর ধরে। প্রথম ম্যাচেই মোশাররফ রুবেল আইইআরের হয়ে পাঁচ উইকেট পেয়েছিল। সেটি ছিল সম্ভবত চারুকলার বা ইতিহাসের বিরুদ্ধে-আমার যতটা মনে পড়ে এবং সেখানেই সে অপরাজিত ৫০ রানও করেছিল। সেই ম্যাচে আমিও ছিলাম তার টিমে। মাঠে থেকে তার পারফরমেন্স দেখে সত্যিকারভাবেই আমরা সবাই মুগ্ধ হয়েছি। এখনো বার, বার মনে পড়ে। টিমকে জিতিয়ে সে মাঠ ছেড়েছিল।
রুবেলের আর অবদান?
আইইআর এর আগেও বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলেছে। আমাদের পূর্ববতী যারা ছিলেন, খেলোয়াড়, অবশ্যই ভালো, তারাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্রিকেট খেলায় অংশগ্রহণ করেছেন কিন্তু আইইআর ক্রিকেট টিমের জয়টি সেভাবে ছিল না। রুবেল আসার পর আমরা প্রথম ম্যাচে এভাবে উইন করে পরের রাউন্ডে উন্নীত হলাম।
লেখাপড়ায় কেমন ছিল?
লেখাপড়ার প্রতি তার আগ্রহ ছিল। সে যে শুধু খেলাধুলা করতো, ব্যাপারটি তা নয়। তার ফলাফলও কিন্তু খারাপ ছিল না। খেলাধুলার পাশাপাশি যতটা সময় পেত, রুবেল পড়ালেখায় সময় দিত। কনফ্লিক্ট যেটি হয়েছে-সেমিস্টার পদ্ধতিতে উপস্থিতির একটি ব্যাপার ছিল, এত শতাংশ (৬০) উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। আবার প্রতি সেমিস্টারে তিনটি করে ইনকোর্স করতে হবে (সেরা দুটি গণনা করা হবে)। ক্লাসগুলোতে অংশগ্রহণ করতে হবে। এই বিষয়গুলোর সঙ্গে একজন জাতীয় মানের খেলোয়াড়ের মানিয়ে নেওয়াটি আসলে খুব ডিফিকাল্ট ছিল। তারপরও সে মানিয়ে নেবার জন্য চেষ্টা করেছে। যেহেতু খেলাটিকে মোশাররফ রুবেল তার ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছে, এক পর্যায়ে এই একটিমাত্র কারণে সে ইতিহাসে চলে গেল।
আমাদের পড়ালেখা নিয়ে তার বক্তব্য?
আইইআরের লেখাপড়ার মান নিয়ে তার কোনো কথা ছিল না। রুবেল সবসময় স্বীকার করেছে, আইইআরের পড়ালেখার মান অবশ্যই ভালো। অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় এগিয়ে কিন্তু পড়ালেখা ও খেলাধুলা-দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজই তাকে একসময়েই পাশাপাশি চালিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে, সেক্ষেত্রে আইইআর তার জন্য সেভাবে সুইটেবল ছিল না।
তারপরও পাঁচটি বছর কেন নিয়মিত এসেছে?
এর একটি কারণ, রুবেলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রবেশদ্বারই হলো আইইআর। এখানে তার জীবনের বন্ধুত্বের সূত্রপাত, তার সব বন্ধু এখানের মানুষ। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমরা যারা ছিলাম, তার পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। সবসময়ই সে বিষয়টি ফিল করেছে। ফ্রেন্ড বা বন্ধুত্ব যে বিষয়টি, রুবেলের জীবনে, তার জন্ম এখানেই। আইইআর থেকেই তার বন্ধুরা ক্রিয়েট হয়েছে। আমরাও তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সবসময় জড়িত ছিলাম। রুবেলের সাবজেক্ট চেঞ্জ হয়েছে, কিন্তু বন্ধুত্বের জায়গাটি তার ও আমাদের তরফ থেকে কখনো নষ্ট হয়নি।
ইতিহাসে ভর্তি হবার পর সে তো আইইআরের বিপক্ষে খেলেছে। এমন কোনো ম্যাচের কথা মনে পড়ে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট টিমে তার অবদান?
যখন সে ইতিহাসে চলে গেল, আমাদের সঙ্গে কিন্তু বিভাগীয় খেলা পড়েনি। ফলে অপনেন্ট হিসেবে রুবেলের সঙ্গে খেলার সুযোগ হয়নি। খেলার সময় আমরা ভিন্ন ভাগে ছিলাম। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তার প্রথম সেই যে ম্যাচটি, সেই পারফরমেন্সে সবাই তখনই বলেছেন, এই রুবেল একদিন বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলবে এবং তার সেই পারফরমেন্স আসলেই জাতীয় দলে খেলার মতোই ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে যখন সে খেলেছে, তোরা তার খেলাগুলো দেখেছিস। কেমন ছিল?
ওই পর্যায় থেকেই আসলে রুবেলের উত্থানের শুরু। তখন থেকে সে প্রথম বিভাগ লিগ, প্রিমিয়ার লীগ ও ন্যাশনাল লিগগুলোতে পারফর্ম করেছে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলে খেলার সুবাদে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিপক্ষে সে খেলেছে। যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন জাতীয় দলের অন্যতম তারকা খেলোয়াড় মুশফিকুর রহিমনহ অন্যান্য খেলোয়াড়রা ছিল। তাদের সঙ্গে একদম সমানে-সমানে লড়াই করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়নও হয়েছে তার কল্যাণে। রুবেলের পারফরমেন্স ছিল বরাবরই চোখে পড়ার মতো।
একজন লম্বা খেলোয়াড়, যে বোলার হওয়া উচিত। সে স্পিনার হয়ে গেল। এতে কী ও কোনো সুবিধা পেত বা তার কোনো অসুবিধা হতো?
না। এই বিষয়টি যদি মনে করি-ওর হাইট বা আয়তন যদি বাংলাদেশের অন্য স্পিনারদের সঙ্গে যদি তুলনা করি, অবশ্যই তাহলে রুবেল ফাস্ট বোলার হবে; কেননা ৬ ফিট এক ইঞ্চি লম্বা, তেমনই ভালো হয়। তবে ওর বোলিং স্টাইলটি যদি দেখেন কেউ-তাতে অসুবিধার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। মোশাররফ রুবেল তার আগের প্রজন্মের, নিউজিল্যান্ডের, অন্যতম বিশ্বসেরা স্পিনার ও জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন ড্যানিয়েল ভিট্টোরির বোলিং স্টাইলটির অনেকটা ফলো করেছে। তার মতোই বোলিং করেছে সে। আই থিংক সো। রুবেলও বলত, ভিট্টোরিকে তার আইডল হিসেবে মনে করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে যখন অন্য লিগগুলো খেলেছে, তার কোনো খেলা দেখছোস?
মাঠে আমাদের অনেকবার রুবেলের খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। যেহেতু আমরা বন্ধু ছিলাম, ফলে যখনই ম্যাচগুলো হত, পড়ালেখার অবসরে আমাদের ডেকে নিয়ে যেত। খেলা দেখতে যেতাম। খেলোয়াড়দের কোটায় বা সৌজন্য টিকেট পাওয়ার সুবিধা আছে, আমাদের সে টিকেটগুলো দিত। আমরাই তো তার খেলাপাগল বন্ধু ছিলাম। ফলে তার খেলা দেখতে যেতাম। রুবেল দীর্ঘদিন বাংলাদেশ বিমানে খেলেছে। সেই ম্যাচগুলো আমরা দেখতে গিয়েছি। অনেক পরামশও দিয়েছি। সেগুলো তার খেলায় এসেছেও। রুবেল আরো ভালো করেছে। এ আমাদের জন্য খুব আনন্দের। যেসব হোটেলে উঠত অন্যদের সঙ্গে, সেগুলোতে আমরা দল বেঁধে তার সঙ্গে গিয়েছি, অন্যসময় কয়েকজন মিলে গিয়েছি। সবাই মিলে আড্ডা দিয়েছি। অন্য জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে গল্প হয়েছে। বড় খেলোয়াড়দের সঙ্গে আলাপ করেছি। আসলে সার্বক্ষণিকভাবে আমরা তার পাশে থেকেছি। সেও সবসময় চেষ্টা করেছে তার খেলার মধ্যেও যাতে আমাদের নিয়ে আসতে পারে।
খেলা দেখার কোনো স্মরণীয় স্মৃতি?
বাংলাদেশ জাতীয় দল যখন প্রথম টেষ্ট ম্যাচ খেলেছে, এই দলের গর্বিত ও ঐতিহাসিক দর্শক হিসেবে আমাদের বন্ধু মোশাররফ রুবেল ম্যাচটি দেখার জন্য এই ম্যাচের জন্য আমাদের টিকেটগুলো কিন্তু অ্যারেঞ্জ করে দিয়েছিল। আমাদের বিশেষত আমাকে বলব, বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট খেলাটি দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের সঙ্গে বসে সে-ও খেলা দেখেছে।
মাঠে বসে তার খেলাগুলো দেখার অভিজ্ঞতা?
আসলেই অন্যরকম। আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড, আমার ক্লোজ একটি বন্ধু রুবেল মাঠে খেলছে...। মিরপুর জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে খেলছে, পারফরমেন্স করছে-এ তো আসলেই অন্যরকম বিষয়।
যে বিদেশী লিগ নিয়ে তার বাংলাদেশ দল থেকে ছিটকে যাওয়া-সেই ইতিহাস কী তুই জানিস? আসলে বাংলাদেশ জাতীয় দল থেকে রুবেল বাদ হয়ে গিয়েছিল কেন?
মেইনলি, ওই সময় সারা বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়রা এই একটি স্রোতের মধ্যে ছিলেন। আমাদের দেশের জাতীয় দলের তারকা খেলোয়াড় রুবেলও তখন তার বাইরে ছিল না। সে যেতে পারেনি প্রতিভা ও অর্জনে। তখন দুনিয়াজুড়ে তুমুল আলোচিত সেই লিগটির নাম আইসিএল (ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ)। আজকের আইপিএলের শুরু কিন্তু এই আইসিএলের হাতে। ভারত তো পাশের দেশ, তাদের ক্রিকেট আমাদের খুব আক্রান্ত করে। ফলে সেখানে যখন টুর্নামেন্টটি শুরু হয়েছিল সেখানে টাকার জন্য তারা খেলতে গিয়েছিল। তখন বাংলাদেশ জাতীয় দলের আয় ও খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক খুব কম ছিল। আরো নানা সমস্যা ছিল। বিস্তারিত তখনকার গণমাধ্যমে এসেছে। এটি একটি বেসরকারী ক্রিকেট লিগ। ২০০৭ ও ০৯ সালে ভারতের বিখ্যাত গণমাধ্যম ‘জি’র ‘জি এন্টারটেইনমেন্ট’ ২০০৭ ও ২০০৯ সালে পরিচালনা করেছে। তাতে বিশ্ব একাদশ, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা দেশের নামে অংশ নিয়েছেন। আর তাদের দেশীয় মোট ৯টি দল ছিল। তারা প্রধান ভারতীয় শহরগুলোর পাশাপাশি লাহোর, ঢাকায় ম্যাচগুলো খেলেছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আসলে একে একটি ‘বিদ্রোহী টুনামেন্ট’ হিসেবে ভারতে ও অন্যান্য দেশে আইসিসির কারণে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাংলাদেশেও। আইসিসি (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) থেকে এই খেলোয়াড়দের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আমাদেরও বোর্ড থেকে জাতীয় দলে নিষিদ্ধ করে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালে পরের সেশনেই ভারতীয় বিসিসিআই (বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া) আইসিএলের বিপরীতে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আজকের আইপিএল একই ফরম্যাটে শুরু করেছেন। এখানে টি২০ ক্রিকেটেরেএভাবে জন্ম। বিদ্রোহী খেলোয়াড় আখ্যায়িত করে যাদের শাস্তি দেওয়া হলো, এই লিগে তারা ছিলেন নিউজিল্যান্ডের ডেমিয়েন মার্টিন, ক্রিস হ্যারিস, ক্রিস ক্রেইনস, শ্রীলংকার মারভান আতাপাত্তু, রাসেল আরনল্ড, ভারতের সুনীল গাভাস্কারের ছেলে রোহান গাভাস্কার, পাকিস্তানের মঈন খান, ইনজামামুল হক, আজহার মেহমুদ, শহীদ নাজির, হাসান রাজা, মোহাম্মদ সামি, ইমরান নাজির, বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন, আফতাব আহমেদ, অলক কাপালি, মানজারুল ইসলাম, মোহাম্মদ রফিক, মোশাররফ হোসেন রুবেল, শাহরিয়ার নাফিস, তাপস বৈশ্য। আইসিএলে আমাদের বন্ধু রুবেল বাংলাদেশের হয়ে তো অংশগ্রহণ করেছিল। যাই হোক, পরবতীতে যখন লিগটি বিদ্রোহী লিগ হিসেবে আখ্যায়িত হলো, এরপর এই লিগে বিভিন্ন দেশের জাতীয় দলের যেসব খেলোয়াড় এই লিগে খেলেছেন, তাদেরকে আর জাতীয় দলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে না বা সুযোগ দেওয়া হবে এই বিষয়গুলো সারা দুনিয়াতে দেশগুলোর মধ্যে ছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেট নির্বাচকদের মধ্যেও এই বিষয়টি ছিল। যারা আইসিএল বা বিদ্রোহী লিগে খেলেছে, তারা আর জাতীয় দলে সুযোগ পাবে না। তবে আশ্চর্য হলো বাকিরা সবাই জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছেন এবং দীঘদিন খেলে সুনামের সঙ্গে অবসর নিয়েঝেন। বাংলাদেশের এই খেলোয়াড়দের আর যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়নি। রুবেল বা অন্যরা কেন পিছিয়ে গেলেন? এরপর আমি সূর্যসেন হলে ছেড়ে দিলাম। রুবেল থেকে গেল।
তখন রুবেলের অনুভূতি?
আসলে মোশাররফ রুবেল তো তখন একজন ইয়াং ক্রিকেট সুপারস্টার। তাদের এই লিগ আয়োজনের আরেকটি লক্ষ্য ছিল, তরুণদের মধ্যে ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করা। তুমুল এই লিগ বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। এমন লিগের রেকর্ড আরো অনেক আছে। যাই হোক, লিগটিতে খেলার আগে বা খেলার সময় সে হয়তো বিষয়গুলোর ভবিষ্যত কী হবে সে চিন্তা করতে পারেনি। ও তো ক্রিকেট নিয়েই থেকেছে। পরে কী হবে সে ভাবেনি, ভাবতেও পারেনি। ভালোবাসার ক্রিকেট খেলাকে যেহেতু সে ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছে, খেলাকে খেলা হিসেবে নিয়ে খেলেছে। সেখানেও কিন্তু পরবতীতে এটি যে বিদ্রোহী লিগ হবে সেটি তার ধারণার মধ্যেই তো ছিল না। যখন জাতীয় দল থেকে এই লিগে খেলার জন্য, মানা না শুনে খেলার জন্য সে বাদ পড়ে গেল; তারপরও অসাধারণ ভালো এই বাংলাদেশের খোলায়াড়টি তার পারফরমেন্স দিয়েই, দেশকে ভালোবেসে আবার জাতীয় দলে ফিরে আসার জন্য বছরের পর বছর বার, বার চেষ্টা করে গিয়েছে। এই পারফরমেন্স দিয়েই কিন্তু সে আবার অনেক বছর পর বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। ২০০৮ সালে একদিনের জাতীয় দলে অভিষেকের পর ২০১৬ সালে আবার ফিরতে হলো তাতে। এ অত্যন্ত দুঃখজনক।
যখন সে বাদ পড়লো, তার মনোভাব বা অনুভূতি কী ছিল?
এটি আসলে হলো, প্রথমে যখন বাদ পড়লো, তখন সত্যিকারভাবেই তার পারফরমেন্স ভালো ছিল। প্রতিটি লিগে সে এরপর অনেক বছর সে এক থেকে তিন-সেরা উইকেট টেকার বোলার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু তার মনোক্ষুন্নের কারণ ছিল, এই পারফরমেন্সের পরও সে বাংলাদেশের হয়ে তার মেধা ও যোগ্যতাকে ব্যবহার করতে পারছে না। আমরা তাকে সর্বান্তকরণে সাহায্য করে গিয়েছি। তুমুল আলোচিত বিদ্রোহী লিগের সমালোচিত খেলোয়াড় সে ছিল, তারপরও একটি জেদ ও মেধার ব্যবহার তার মধ্যে সবসময় কাজ করেছে-আমি আমার পারফরমেন্স দিয়ে আবার একসময় বাংলাদেশের দলে ব্যাক করবে। আলটিমেটলি সে কিন্ত তার পারফরমেন্স দিয়ে জাতীয় দলে ব্যাক করেছে।
অনেক বছর পরে?
এটি আসলেই অনেক বছর পর। সে যদি প্রথম থেকে ন্যাশনাল টিমে খেলার সুযোগ পেত, আমি মনে করি-বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট রুবেলের কাছ থেকে আরো অনেক বেশি পেতে পারতো।
রফিকের চেয়ে ভালো হতো?
এই রফিক ভাই আইসিএলে খেলেছেন। তবে রুবেলকে মানা করার পরও সে পরের সেশনে খেলেছে। সে খেলতে পারলে মোহাম্মদ রফিক ভাইয়ের চেয়ে ভালো হতো-এটি বলবো না। রফিক তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের ক্ষেত্রে একজন আইডল প্লেয়ার কিন্তু উইকেট টেকিংয়ের তার পরের জেনারেশনে এই প্রজন্মে আসলে রুবেল ছিল ওয়ান অব দি বেস্ট স্পিনার। সে একজন লেফট আর্ম অথডক্স স্পিনার।
মাঝখানে যখন অনেক বছর খেলেনি, তখন সে খেলতো কোথায়?
বাংলাদেশ ন্যাশনাল টিমে রুবেল খেলতে পারেনি-কিন্তু আমাদের যেসব লিগ তখন ছিল, ন্যাশনাল লিগ, ক্লাব টুর্নামেন্ট, বিপিএলে খেলেছে। এই বিপিএলে নিয়মিত খেলেছে সে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই দলে সে কিন্তু অবশ্যই পারফরমেন্স করেছে নজরকাড়া। তার পারফরমেন্স অনেক ভালো ছিল।
জাতীয় দল থেকে যখন বাদ পড়ে গেল, কোন ক্লাবে খেলতো?
ও আসলে বাংলাদেশ বিমানে দীর্ঘদিন খেলেছে। হাবিবুল বাশারের দলে।
তাকে মানুষজন কীভাবে নিত? একটি ছেলে দল থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে, তাকে আর নেওয়া হবে না-এরকম একটি সিদ্ধান্তে অন্য খেলোয়াড়রা তাকে কীভাবে দেখতেন?
অন্য খেলোয়াড়রা, এটি যদি বলি-ক্রিকেটারদের অভ্যন্তরীণ অনেক কিছুই থাকতে পারে কিন্তু তখন আমাদের প্রথম সারির যেসব খেলোয়াড় ছিলেন, অনেকে বিষয়টি পজেটিভলি নেননি। আবার অনেকে নিয়েছেন-ও তো আমারই সমসাময়িক, আমারই ভাই। সে হয়তো একটি ভুল করেছে কিন্তু যদি তখনকার রেকর্ড দেখেন, হাবিবুল বাশার সুমন কিন্তু আইসিএলে খেলেছেন। পরে আবার জাতীয় দলে ব্যাক করেছেন ও ক্যাপ্টেন হয়েছেন। বিমানেরও। এখন কিন্তু তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক।
রুবেল পারেনি কেন?
আমরা যদি চিন্তা করি, আসলে ইন্টার্নাল বেশ কিছু ইস্যু থাকে। ক্রিকেটের বাইরে আমরা যারা আছি, এই জিনিশগুলো যদি চিন্তা করি, রুবেল আসলে খুব সাদামাটা একটি ছেলে। তার আসলে যদি পারফরমেন্সের পাশাপাশি লবিংয়ের যদি হিসাব থাকে, বিষয় থাকে; এই কাজটি করতে হবে-এই বিষয়টিই তার মধ্যে ছিল না। সে তার মেধা ও যোগ্যতা দিয়েই বাংলাদেশে পরে সুযোগ পেয়েছে। হয়তোবা আরো আগে খেলতে পারতো, সে পায়নি। পেছনে মামা, চাচা বা এমন কোনো ব্যাকআপ থাকলে রুবেল আরো আগেই জাতীয় দলে চান্স পেত।
রুবেল জাতীয় দলের খেলা দেখত?
যেহেতু খেলার মাঠেই থাকতো বেশিরভাগ সময়, খেলাই তার জীবন ও জীবিকা-খেলাগুলো অবশ্যই দেখত।
এই নিয়ে কোনো দুঃখ ছিল?
আইসিএল খেলার পর যখন দীর্ঘদিন তাকে টিমের বাইরে রাখা হলো, এটি তার মনোকষ্টের বিরাট কারণ ছিল। একটি পর্যায়ে কিছুদিনের মধ্যে সে ভুল বুঝতে পেরেছে ন্যাশনাল ক্রিকেট টিমকে সার্ভ না করে এই জায়গায় যাওয়াটি ভুল হয়েছে। কিন্তু এটি তো আগের ডিসিশন ছিল না যে, যারা আইসিএলে যাবেন, তারা আর এখানে খেলতে পারবেন না। এই লিগকেই যখন বিদ্রোহী লিগ বলা হয়েছে, তখন এই খেলোয়াড়দের ব্যান করার একটি চিন্তাভাবনা হয়েছে। সেটি হয়েছেও। কিন্তু রুবেলের মধ্যে একটি জেদ ছিল, খুব খারাপ লাগা ছিল, এই জেদ থেকে সে ন্যাশনাল টিম ও বাংলাদেশকে সার্ভ করতে চেয়েছে। সার্ভ করতে পারছে না-এই কষ্ট থেকে ভালো খেলা তার জীবনের পরবর্তী পাথেয় ছিল। সে কষ্ট করেছে, পারফরমেন্স করে গিয়েছে বছরের পর বছর, তার মাধ্যমেই আবার জাতীয় দলে চান্স পেয়েছে।
আমরা যারা বাইরের লোক, তারা মনে করি, সে লিগগুলো খেলে, খ্যাপে গিয়ে অনেক টাকা-পয়সা কামিয়েছে। ব্যাপারটি কী তাই?
সেই দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে যেহেতু সে প্রথম সারির ক্রিকেটার ছিল, ন্যাশনাল টিমের প্লেয়ার ছিল; ওই হিসেবে ঢাকা বিভাগ, বরিশাল বিভাগ, বিপিএল খেলেছে। সাধারণ যে লিগগুলো আছে, সেগুলোর চেয়ে এগুলোতে টাকা অনেক বেশি। যেমন ন্যাশনাল টিমে খেলার চেয়ে আইপিএলে টাকার পরিমাণ অনেক বেশি। আইসিএলেও তাই। যারা আইপিএলে খেলেন, তারা অনেক কামাই করেন। রুবেল খুব যে আহামরি টাকা খেলার মাধ্যমে কামিয়েছে তা নয়। খেলার মাধ্যমেই সে পেশাজীবনের টাকা আয় করেছে। আসলে তার খেলোয়াড় হিসেবে প্রাপ্য যে সম্মান ও অথটুকু পাওয়ার কথা ছিল, সেটুকুই পেয়েছে ও। আমি এটি মনে করি।
তার পরিবারের অবস্থা কেমন ছিল?
ও আসলে কিশোরগঞ্জ থেকে উঠে আসা একটি ছেলে। তার বাবা-মা সেখানেই ছিলেন। তার বাবা কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। রুবেল তার পরিবারের প্রতি ডেডিকেটেড ছিল। সে সবসময়ই তার ফ্যামেলিকে সার্ভ করার চেষ্টা করেছে, দেখাশোনা করেছে। সবসময়ই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
তোর তো খেলার প্রতি আগ্রহ আছে, রেগুলার ক্রিকেটার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার অভিজ্ঞতাও আছে। তার ক্যারিয়ার কেমন?
রুবেলের ক্যারিয়ারটি যদি বিশ্লেষণ করি, আসলে যেকোনো প্লেয়ারের জন্য উত্থান, পতন-এই দুটি জিনিশ আছে। আমরা যদি টপ ক্লাস ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকারকে দেখি, তিনি যেমন সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করেছেন, কিন্তু তারও খারাপ সময় কিন্তু গিয়েছে। দুই মাস, তিনমাস, ছয়মাস, পাঁচটি, ১০টি ম্যাচ রান করতে পারেননি। পরে আবার রানে ফিরেছেন। রুবেলের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে জাতীয় দলে ফেরা বাদে। একজন খেলোয়াড় হিসেবে তার ক্যারিয়ারের উত্থান, পতন হয়েছে। ভালো সময় গিয়েছে, খারাপ সময়ও কেটেছে। রুবেলের ক্ষেত্রে আমি মনে করি, এই খারাপ সময়টি খুবই কম গিয়েছে।
টেন্ডুলকার তো ইন্টারন্যাশনাল স্টার, রুবেল কী তাহলে লিগের স্টার?
এখন বলতে গেলে, আসলে লিগ স্টার তো অবশ্যই। তবে এখানকার এই তারকাকে যদি ঠিক মতো সুযোগ দিতে পারতাম আমরা, তাহলে সে অবশ্যই বাংলাদেশের স্টার হতে পারত। সে সুযোগ ও দারুণ সম্ভাবনা তার মধ্যে ছিল।
তার প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে?
রুবেল আমাদের ফেন্ড সার্কেলের মধ্যে বিয়ে করেছে। তার স্ত্রী চৈতি-চৈতি ফারহানা। তাদের পরিচয়ে প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপার ছিল না। জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার মঞ্জু ভাই (বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক বাঁহাতি ফাষ্ট বোলার মানজারুল ইসলাম), নাহিদ (পুরো নাম?), আমি, অঞ্জন, জিন্নাহ-তারাই মূলত তাদের বিয়ের বিষয়ে অগ্রসর হয়েছি। কয়েক বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। আমি তার বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। ঢাকার বেইলি রোডের অফিসার্স ক্লাবে অনুষ্ঠান হয়েছে। তার স্ত্রী চৈতী ভাবী মোটামুটি কিছু করেন।
কিভাবে বিয়ে হলো?
একদিন ঢাকার রাইফেলস স্কয়ারে (এখন সীমান্ত স্কয়ার, ঢাকার বিডিআর বা বিজিবি সদর দপ্তরের পাশে, তাদের মালিকাধীন মার্কেট) সন্ধ্যায় আমি, মঞ্জু ভাই, জিন্নাহ আড্ডা দিচ্ছিলাম। রুবেলও ছিল। তখন জিন্নাহ ও মঞ্জু ভাইয়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের এখন চৈতি ভাবীর কথা প্রথম শুনলাম। মঞ্জু ভাই রুবেলকে বলছিলেন, ‘রুবেল যতটা জানলাম, আমার মনে হয় মেয়েটি ও তার পরিবারটি ভালো। আমরা মনে হয় এগুতে পারি। এখন তুমি কী বলো?’ দেন রুবেল বলল, ‘ঠিক আছে ভাই, আপনারা দেখতে পারেন।’ এরপর তো চৈতি ভাবীর সঙ্গে তার বিয়ে হলো। সংসার শুরু হলো।
আগে থেকে ভাবীকে চিনতি?
না, আমি আগে থেকে চিনতাম না। বিয়ের পর পরিচয় হলো।
ঘটকালি বা এমন কোনো কাজে যুক্ত হতে হয়েছে?
না (হাসি), আসলে এই কাজ আমাদের করতে হয়নি। এক ফ্রেন্ডের পরিচিত, সেই থ্রুতে বিয়ে।
বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা মনে আছে?
সেখানে তো আমরা তার ক্লোজ ফ্রেন্র্ড সাকেল সবাই গিয়েছিলাম। অনেক লোক ছিল। ক্রিকেট বোর্ডের লোক, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রেন্ডরা, তার বিকেএসপির বন্ধুরা, ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যেহেতু বিভিন্ন ক্লাবে খেলেছে, এই দলগুলোর কর্মকর্তারা ছিলেন, সহ-খোলেয়াড়দের মোটামুটি সবাই অ্যাটেন্ড করেছেন। আত্মীয়স্বজনরা তো ছিলেনই।
তারা থাকতো কোথায়?
ঢাকার মোহাম্মদপুরের জাপান-গাডেন সিটিতে। রবেলের নিজের ফ্ল্যাট ছিল। ফ্ল্যাটটি কিনেছিল। এখন থেকে সে যখন অসুস্থ হয়ে পড়লো, বারিধারা ডিওএইচএসে শিফট করল।
তার ওয়াইফ কী করতেন?
চৈতি ভাবী একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে আছেন। ঠিক এই মুহূর্তে নাম বলতে পারছি না। তবে যখন বিয়ে হলো, তখনও এমন একটি প্রতিষ্ঠানে ছিলেন। তিনি মিডিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। একটি শোবিজ বা শেয়ার রিলেটেড কোনো একটি প্রগ্রাম উপস্থাপনা করতেন টিভিতে।
দেখতে, শুনতে ভালো?
হ্যা, অবশ্যই।
তাদের একটি বাচ্চা আছে?
ছেলে। সাড়ে তিন বছর বয়স।
রুবেলরা ভাইবোন কতজন?
তারা দুই ভাই, দুই বোন। বড় বোন, তার পর ভাই। বড় ভাইয়ের নাম তৌহিদ। তিনি ক্রিকেট খেলেন না। আমাদের রুবেল এবং আরেক বন্ধু হুমায়ূন তাদের একত্রে যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, নাম ম্যাক্সপ্রো। এটি একটি ডেভেলপার কম্পানি। এটলাস গ্রুপে তাদের একটি মালিকানা অংশ আছে। সেখানে কাজ করেন।
তাহলে তারা বড়লোক?
ব্যাপারটি বড়লোক নয়, ‘ফ্রম দি বিগেনিং’ সে অন্ট্রারপ্রেনার হিসেবে ডেভেলপ করেছে। মোটামুটি মাশাল্লাহ একটি ভালো অংক আছে তার।
তার ছেলের নাম?
রুশদান।
রুবেলের ওয়াইফ কেমন?
তিনি তো আসলে অমায়িক। তার যে দূরারোগ্য ক্যান্সার-এই যুদ্ধের সময়ে আসলে আমরা বুঝতে পেরেছি, ভাবি কতটা অমায়িক ছিলেন বা তার প্রতি ডেডিকেটেড হয়ে কাজ করেছেন।
রুবেল তোকে পছন্দ করতো কেন? সে তো সুপারস্টার।
আসলে বন্ধুত্বের কোনো সংজ্ঞা হয় না। বন্ধুত্বে কে কোথায় আছি, কে কত ওপরে বা কে কত নীচে, কে কোন ফ্যামিলি থেকে এলাম, কার জাত, ধর্ম কী-এই বিষয়গুলো দিয়ে কেউ বন্ধুত্বের সংজ্ঞাকে সংজ্ঞায়িত করতে পারবে না।
রুবেল মানুষ হিসেবে কেমন ছিল?
আমি একদম প্রথমেই বলেছি, সে মানুষ হিসেবে অমায়িক ছিল।
কী খেতে ভালোবাসতো?
সব ধরণের খাবারই পছন্দ করতো। বিরিয়ানি, আমরা যাকে বাংলা খাবার বলি-মাছে, ভাতে বাঙালি-এই ধরণের মানুষ ছিল।
প্রতিটি খেলোয়াড়েরই তো কোনো না কোনো স্পেশালিটি থাকে। তার কী ছিল?
খেলোয়াড় হিসেবে যদি বলি, সে লেফট আর্ম স্পিনার ছিল কিন্তু ভালো ব্যাটসম্যান ছিল। আমরা যখন ইউনিভার্সিটি টিমে দেখেছি, সে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেছে। ন্যাশনাল টিমে যেহেতু আরো অনেক স্বনামধন্য ব্যাটসম্যান ছিলেন, এই ব্যাটিংয়ের জায়গাটি তার জন্য সেভাবে পোক্ত করতে পারেনি, শেষের দিকে ব্যাট করত।
তার দুঃখ?
জাতীয় দলে খেলতে না পারাটি তার একটি কারণ।
তুই কী তার বাড়িতে গেছস?
না তার বাড়িতে যাবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। অনেকবার যাওয়ার প্ল্যান ছিল, কিন্তু...।
মায়ের সঙ্গে তার কখনো কথা হয়েছে?
হ্যাঁ, খালাম্মার সঙ্গে কথা হয়েছে, কিন্তু অল্প সময়ের জন্য।
দেখা হয়েছে?
তার বারিধারা ডিওএইচএসের বাসায়, তাও অল্প সময়ের জন্য।
এই ছেলেকে নিয়ে তার আশা কী ছিল?
খালাম্মা তার সন্তানদের প্রত্যেককে নিয়েই আসলে অনেক বেশি গর্ববোধ করেন। একটি পর্যায়ে স্টাবলিস্ট হওয়ার পর আর ফ্যামেলির প্রতি অতটা ডেডিকেটেড থাকে না কিন্তু তার চার ছেলে, মেয়েই ফ্যামেলির প্রতি ডেডিকেটেড। তিনি তার প্রতিটি ছেলে, মেয়েকেই অনেক ভালোবাসেন। রুবেল তো আসলে তার গর্বের জায়গা। সে এত ভালো ক্রিকেট খেলত, ন্যাশনাল টিমে পার্টিসিপেট করেছে, দেশকে রিপ্রেজেন্ট করেছে। এটি আসলে যে কোনো মায়ের জন্যই বড় গর্বের।
আশা বা ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী ছিল রুবেলের?
ক্রিকেটকেন্দ্রীক আরো ভালো ক্যারিয়ার করতে চেয়েছে ও। বাংলাদেশ জাতীয় দলকে আরো অনেক বেশি সার্ভ করতে চেয়েছে সে। তার শারিরীক অসুস্থতার কারণে শেষ পযন্ত পারলো না কিন্তু ক্রিকেট খেলা শেষে, একজন খেলোয়াড়ের খেলা জীবন পেরুনোর পর, তারও ক্রিকেট নিয়েই থাকার আগ্রহ ও বাসনা ছিল। হয়ত কোনো ক্রিকেট কোচিং সেন্টার বা একাডেমি অথবা কোচ হিসেবে মোশাররফ রুবেল আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিল।
রুবেলের ক্যারিয়ার রেকর্ড?
বাংলাদেশের হয়ে মোট পাঁচটি ওয়ানডে খেলেছে। সব্বোর্চ রান করেছে ৮, মোট ২৬। বল করেছে স্পিনার হিসেবে, মোট ৪টি উইকেট পেয়েছে। শুরু করেছিল অলরাউন্ডার হিসেবে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লিস্ট ‘এ’ বা প্রথম শ্রেণীর লিগ ম্যাচে ১শ ৪ ম্যাচে তার মোট রান ১ হাজার ৭শ ৯২। সবোর্চ্চ ৮৮। গড় ২৪.৮৮ রান। মোট ১শ ২০ উইকেট নিয়েছে। ৫৭ রানে ৫ উইকেট সেরা। টি২০তে ৫৬ আন্তজাতিক ম্যাচে ৬২ রান। উইকেট ৬০।
ছবি : ১. বিদেশে রুবেল-বন্ধু জিন্নাহর সৌজন্যে পাওয়া।
২. খেলাপাগল আজীবনের বন্ধু টুটুল ও রুবেল।
৩. বাংলাদেশ দলের অ্যাকশনে রুবেল।
৪. স্ত্রী চৈতী ফারহানাকে নিয়ে বন্ধু টুটুলের সঙ্গে।
(২৬ এপ্রিল, ২০২২, আইইআর ক্যান্টিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)