নেত্রকোনায় হচ্ছে শৈলজারঞ্জন মজুমদার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
সংগীতজ্ঞ ও সুরকার শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মস্থান নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে নির্মাণ করা হচ্ছে 'শৈলজারঞ্জন মজুমদার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র'। বেশ কিছু রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপিও লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের সহচর শৈলজারঞ্জন মজুমদার।
কলকাতার শান্তিনিকেতনে রসায়নের অধ্যাপক হলেও, তাকে ছোটদের গান শেখানোর গুরু দায়িত্ব দিয়েছিলেন কবিগুরু। সেটিও তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন তিনি। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি দেশের ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার।
তার কাছ থেকে গান শিখেছেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, সুচিত্রা মিত্র, অরুন্ধতী দেবীর মতো প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীরা। নীরবে-নিভৃতে কাজ করে আসা এ মানুষ সবসময়ই প্রচারের আড়ালে ছিলেন। সেই আড়ালে থেকেই ১৯৯২ সালের ২৪ মে পৃথিবীকে চিরবিদায় জানান।
তার মৃত্যুর ২৬ বছর পর তার জন্মস্থান নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে নির্মাণ হতে যাচ্ছে 'শৈলজারঞ্জন মজুমদার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র'। আর তা নির্মাণ হলে নেত্রকোনা হয়ে উঠবে দুই বাংলার রবীন্দ্রপ্রেমীদের কাছে এক সেতুবন্ধন ও মিলনক্ষেত্র। গণপূর্ত অধিদপ্তর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি নির্মাণ করবে এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এর কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার বাহাম গ্রামে শৈলজারঞ্জন মজুমদার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি নির্মিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। কাজও শুরু হয়েছে পুরোদমে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করা হবে। যার বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৯ কোটি টাকা।
শৈলজারঞ্জন মজুমদার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অন্যতম উদ্যোক্তা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান বলেন, আমার জন্ম এ এলাকায়। সে কারণে শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে জানার সুযোগ হয়েছে। আমার বাবার সঙ্গে উনার সখ্য থাকায় আরও কাছ থেকে তাকে দেখেছি। তার প্রাজ্ঞতা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত।
তিনি আরও বলেন,রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপি রচনা এবং অবিকৃত সুরে ও উচ্চারণে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনে তার জুড়ি নেই। এলাকার মানুষের দাবি এবং আমার অভিজ্ঞতা মিলিয়েই এ উদ্যোগ গ্রহণ করি। পরে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় শৈলজারঞ্জন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।
জানা গেছে, একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে যা থাকার তার সবই থাকছে শৈলজারঞ্জন মজুমদার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। কেন্দ্রটিতে সংগীতবিদ্যালয়ের ব্যবস্থা থাকবে। যেখানে এক সময় তার বাসভবন ছিল। বিদ্যালয়ের পাশাপাশি একটি মুক্তমঞ্চও থাকবে। এর পাশাপাশি মহড়াকক্ষ ও গ্রন্থাগার থাকবে। এ ছাড়া শৈলজারঞ্জন মজুমদার স্মৃতিচিহ্ন ও ব্যবহৃত দ্রব্যাদি নিয়ে একটি জাদুঘরও থাকবে এ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। থাকছে সবুজ চত্বর ও পুকুর।
শৈলজারঞ্জন মজুমদার ১৯০০ সালের ১৯ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। রমণীকিশোর দত্ত মজুমদার ও সরলা সুন্দরীর অষ্টম সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় তিনি। শৈলজারঞ্জন মজুমদার তার ঠাকুরমার কাছেই গান শেখেন। তারপর তিনি স্থানীয় শিল্পীদের কীর্তন, শ্যামাসংগীত, বাউল, ভাটিয়ালীর মতো লোকসংগীতশুনে গান আয়ত্ত করেন। পূর্ববঙ্গে প্রথম তারই উদ্যোগে নেত্রকোনায় রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করা হয়।
১৯৩২ সালে শান্তিনিকেতনে রসায়নশাস্ত্রে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষাগ্রহণ করেন। এ সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছেও গান শেখেন। ১৯৩৪ সালে তিনি প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপি তৈরি করেন। গানটি ছিল 'মম মন উপবনে'। ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ তাকে ছোটদের গান শেখানোর দায়িত্ব দেন। ১৯৮৫ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'দেশিকোত্তম' সম্মাননা পান।
জেলা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অসিত কুমার ঘোষ বলেন, শৈলজারঞ্জন মজুমদার শুধু এলাকা, দেশ নয় সংগীতের জগতে ভারতবর্ষের এক অন্যতম প্রতিভা।শৈলজারঞ্জন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে এ প্রজন্মের মানুষ তার সম্পর্কে জানতে পারবে। নিজেদের চেতনা সমৃদ্ধ করতে পারবে।
জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক ননী গোপাল বিশ্বাস বলেছেন, আমাদের বাংলা সংগীতের এক প্রধান শ্রেণির উস্তাদ তিনি। তার অবদান ও আদর্শ সংগীতশিল্পী জীবনের পাথেয় হয়ে কাজ করবে। তার জন্য নির্মাণাধীন কেন্দ্র সংগীতজগতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে অবদান রাখবে।
এসএন