ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির বুননে বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তার অবদানের প্রতি কীভাবে বিশেষ উপায়ে শ্রদ্ধা জানানো যায়? একজন লোকশিল্প গবেষক হিসেবে ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করার বিষয়ে ভাবতে থাকি। ভাবনার এক পর্যায়ে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির বুননে বঙ্গবন্ধুর মুখাবয়বের প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলার চিন্তা মাথায় কাজ করতে থাকে।
আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশি ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পপ্রীতির কথা জানি। তিনি নিজের দেশের ঐতিহ্যবাহী কুটির-শিল্পকে অত্যন্ত উঁচুমানের শিল্প বলে গণ্য করতেন। তার সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে একটি বিষয় গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, বাঙালি জাতিকে বিশ্বের বুকে টিকে থাকতে হলে লোক-সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হবে। সেজন্য ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পীদের শিল্পকর্ম নির্মাণ ও বাজারজাতকরণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালে গণপরিষদে বিল উত্থাপন করে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তার এ সুদূরপ্রসারী দূরদৃষ্টির ফলেই আমাদের বেশকিছু লোকশিল্প আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। এদেশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প ইউনেস্কোর 'অধরা বিশ্ব ঐতিহ্য' (Intangible Cultural Heritage of the World) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
২০১৭ সালে বৃহত্তর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটিকে এ স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। সে সময় আমি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে কর্মরত। এ উপলক্ষে আয়োজিত শীতলপাটির প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী পাটিকর অজিত কুমার দাশের বুনন-কৌশল নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। বংশ পরম্পরার এ শিল্প মাধ্যমের ইতিহাস, বুনন-কৌশল প্রভৃতি খুঁটিনাটি দিক নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল। প্রদর্শনীর ক্যাটালগে একটা আর্টিকেলও লিখেছি। আমার মনে হলো, শীতলপাটির শিল্পী অজিত কুমার দাশই একমাত্র পাটিশিল্পী, যিনি তার শিল্পীমন, অনন্য বুনন দক্ষতা ও গভীর ধৈর্য্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাসিমাখা মুখ মসৃণ বেতের বুননে শীতলপাটিতে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন।
আমার বিশ্বাস বৃথা হতে দেননি অনন্য-সাধারণ গুণী পাটিশিল্পী। আমি তাকে উদ্বুদ্ধ করি এ বলে যে, বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, নকশাকার। সদ্য স্বাধীন, শিশু রাষ্ট্রকে নির্মাণ করতে গিয়ে নিজের বুকের তাজা রক্তে এ মাটি ভিজিয়ে শহীদ হয়েছেন!
আমাদের লোকশিল্প, বিশেষ করে শীতলপাটির প্রতি তার বিশেষ টান ছিল। তার জহুরির চোখ, তিনি শিল্পী রশিদ চৌধুরীকে গণভবনে তার দপ্তর ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের উপাদান দিয়ে সাজিয়ে দিতে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গভবনে তার বিশ্রামকক্ষের বিছানায় অতি সাধারণ নকশার একটা শীতল পাটিতে শুয়ে ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নিতেন। তার বিছানার শিথানের দিকের কাঠও শীতলপাটিতে মুড়িয়ে দিতে বলেছিলেন বলে শোনা যায়। জাতীয় জাদুঘরের মুক্তিযুদ্ধের ৪০ নম্বর গ্যালারিতে বঙ্গবন্ধুর শরীরের স্পর্শমাখা সেই সাধারণ অথচ অনন্য শীতলপাটির বিছানা দর্শকদের জন্য প্রদর্শন করা হচ্ছে।
আমি শিল্পী অজিত কুমার দাশকে বঙ্গবন্ধুর শীতলপাটি প্রীতির এ ইতিহাস শোনাই। তারপর বলি, পারবেন না বাংলার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এ মহান বাঙালি, আমাদের জাতির জনকের হাসিমুখটা শীতলপাটির বুননে ফুটিয়ে তুলতে!? দৃপ্ত কণ্ঠে জানালেন— তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।
আমার কাছে জানতে চাইলেন বঙ্গবন্ধুর কোন ছবি অনুসরণ করবেন। আমি বললাম, যেটা তার ভালো লাগে। তিনি বেছে নিলেন বঙ্গবন্ধুর হাসিমাখা মুখ দিয়ে তৈরি “মুজিব শত বর্ষ” লোগো।
এভাবেই বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার, রাজনগর উপজেলার ধূলিজুরা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির পাটিকর অজিত কুমার দাশ বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসীম ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ বুনন করেন বঙ্গবন্ধুর উজ্জ্বল হাসিমাখা মুখ। বাইশ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে বেতের নিজস্ব রঙের সঙ্গে লাল-খয়েরি রঙ মিশিয়ে এটি বোনা হয়েছে।
এভাবেই বিশ্ব ঐতিহ্য শীতলপাটির লোকশিল্পী অজিত কুমারের কারু-বুননে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী হাসিমাখা মুখটি বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠল!
বঙ্গবন্ধুকে এ অনন্য উপায়ে শততম জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারার পুরো গৌরব অজিত কুমারের। আমি শুধু তার সৃজনশীলতাকে উসকে দিয়েছি মাত্র। সর্বপ্রথম শীতলপাটির বুননে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সৃজন করে পাটিশিল্পের ইতিহাসে তিনিই প্রথম প্রতিকৃতি তৈরির পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন।
বাংলার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ মানুষের হৃদয়ে অক্ষয় হয়ে আছেন— থাকবেন চিরকাল!
লেখক: লোকশিল্প গবেষক, লেখক, প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর।
এসএন