‘মালবেরি’ ফল চাষে নওগাঁয় নতুন সম্ভাবনা
নওগাঁর সাপাহার উপজেলায় 'বরেন্দ্র এগ্রো পার্কে' বিভিন্ন দেশ থেকে ৮ প্রজাতির ‘মালবেরি’ ফলের চারা সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করেছেন পুরস্কারপ্রাপ্ত যুব কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানা। প্রথমবারেই ভালো ফলনে বিদেশি এ ফল চাষে দেখা দিয়েছে জেলার কৃষিতে নতুন সম্ভাবনা।
‘মালবেরি’ বা ‘তুঁত’ ফলের আদিবাস চীন হলেও এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে এটি চাষ হয়ে থাকে। ‘মালবেরি’র জুস, জ্যাম জেলী হয়।
‘মালবেরি’ ফলের জুস খুবই সুস্বাদু । জুসটি কোরিয়া, জাপান ও চায়নায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। ক্যানসার প্রতিরোধসহ ঔষধী গুণ ছাড়াও এই ফলের গাছের বাকল, পাতা ও কাঠের বহুবিধ ব্যবহারের কথা শোনা যায় কৃষিবিদসহ প্রবীনদের মুখে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যেন শুধু ফল দেয়ার জন্যই গাছটির জন্ম। গাছে পাতার চেয়ে ফল বেশি ধরে আছে। গাছের পাতা ডিম্বাকার, চমৎকার খাঁজযুক্ত এবং অগ্রভাগ সূঁচাল। আকারে আঙুরের চেয়ে কিছুটা বড় এই ফল। ‘মালবেরি’ ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ফুল আসে এবং মার্চ-এপ্রিলেই ফল পাকে। প্রথম অবস্থায় সবুজ পরে লাল এবং সম্পূর্ণ পাকলে কালো রং ধারণ করে। দেখতে খুবই সুন্দর, আকর্ষণীয়। পাকা ফল রসালো এবং টক-মিষ্টি। প্রতিটি গাছ থেকে ৮-১০ কেজি ফল সংগ্রহ করা যায়। এবং চারাও তৈরি করা যায়। এবং খুব সহজেই ছাদে এর চাষ সম্ভব।
এ বিষয়ে যুব কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানা জানান, পুষ্টিগুণসম্পন্ন ‘মালবেরি’ এই ফলটি বিদেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় এবং বাজারজাত করা হয়। নতুন এই ফলটি আমি পরীক্ষামূলকভাবে থাইল্যান্ড, ভারত, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া ও ইতালিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ৮ প্রজাতির চারা সংগ্রহ করে এ চাষ শুরু করেছি। এবং পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিটা গাছে সাফল্য এসেছে। এবং প্রচুর পরিমাণে ফল ধরেছে।
সোহেল রানা বলেন, 'এ ফল চাষে রোগবালাই খুবই কম। কীটনাশকও তেমন লাগে না। উৎপাদন খরচও কম। শুধু জৈব সার দিলে প্রায় সারা বছরই এই ফল পাওয়া যায়। যেহেতু ‘মালবেরি’ আমদানি নির্ভর একটি ফল। বাজারে এই ফলের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। রাজধানীর সুপার শপগুলোতে বিক্রি হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা কেজি দরে।'
তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে চারটি জাত পছন্দ করেছি। চারা তৈরি করে এক বিঘা জমিতে চারশটি গাছ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে এই ‘মালবেরি’ চাষ করবো। অনেক যুবক উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে এই বিদেশি ফল দেখতে বরেন্দ্র এগ্রো ফার্ম পরিদর্শন করছেন। সম্প্রতি জেলা কৃষি সপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ‘মালবেরি’ গাছগুলো ভিজিট করেছেন। তিনি বাণিজ্যিকভাবে বাগান তৈরি করতে পরামর্শ দেন। যদি বাণিজ্যিকভাবে ‘মালবেরি’ ফলের বিস্তীর্ণ জমিতে চাষ করা যায়। তাহলে স্থানীয় পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে সারাদেশে এর বাজারজাত করা সম্ভব।'
‘মালবেরি’ ফল বাগান দেখতে আসা যুবক সবুজ হোসেন জানান, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বরেন্দ্র এগ্রো পার্কে বিদেশি নতুন জাতের ‘মালবেরি’ ফলের চাষ হচ্ছে তাই উদ্বুদ্ধ হয়ে দেখার জন্য আসছি। এখানকার ফলটি খেয়ে খুবই ভালো লাগলো এবং অনেক সুস্বাদু। এখানে এসে জানলাম ছাদেও নাকি গাছটি লাগানো যাবে। তাই এখান থেকে কয়েকটি চারা নিয়ে গিয়ে ছাদে লাগাবো।
বরেন্দ্র এগ্রো পার্কে ঘুরতে আসা গৃহিনী মমতাজ বেগম বলেন, ‘মিশ্র এই ফল বাগান ঘুরতে এসে দেখলাম বিদেশি ‘মালবেরি’ ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। গাছগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ফল ধরেছে। দেখে খুবই ভালো লাগলো। থোকায় থোকায় কত সুন্দর ভাবে ধরে আছে। এখান থেকে চারা নিয়ে আমার বাড়ির সামনের বাগানে লাগাবো বলে নিয়ত করেছি।'
প্রতিবেদন করতে আসা স্থানীয় সংবাদ কর্মী সুমন আলী বলেন, সোহেল ভাইয়ের বাগানে ‘মালবেরি’ এই ফলের গাছটি দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি। থোকায় থোকায় এতো বেশি পরিমাণে ফলটি ধরেছে। কোনটা সবুজ, কোনটা লাল আবার কোনটা কালো রং ধারণ করে আছে। এই ফলটি আমাদের এলাকায় আগে কখনও দেখি নাই বা চাষাবাদ করা হয় নাই। সোহেল ভাইয়ের কাছ থেকে শুনলাম বাজারে নাকি এর চাহিদা অনেক। এবং দামও ভালো। তাই আমি মনে করি কৃষকরা যদি 'মালবেরি' এই ফলটি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে তাহলে তারা ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারবেন।'
পার্শ্ববর্তী জেলা জয়পুরহাট জেলা থেকে আসা কৃষক জয়নাল জানান, আমি এই বাগানে থেকে বেশ কিছু দিন ধরে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ফলের চারা সংগ্রহ করি। এখান থেকে ‘মালবেরি’ ফলের কয়েকটি চারা কিনলাম। লাগানোর পর ভালো ফল ধরলে বেশি পরিমাণ জমিতে এই মালবেরি চাষ করবো বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পরিচালক কৃষিবিদ শামছুল ওয়াদুদ বলেন, 'সোহেল রানা একজন সফল যুব কৃষি উদ্যোক্তা। দীর্ঘদিন থেকেই বিভিন্ন ফল, ফুল, আমসহ নানা ধরনের মিশ্র বাগান গড়ে তুলেছেন। সম্প্রতি তিনি পরীক্ষামূলকভাবে ৮ প্রজাতির ‘মালবেরি’ ফলের চাষ শুরু করেছেন। বর্তমানে গাছগুলী থেকে ফল তোলার উপযোগী সময় হয়েছে। প্রতিটি গাছে থেকে প্রায় ৮-১০ কেজির মত ফল পাওয়া যাবে। এই অঞ্চলের মাটিও ‘মালবেরি’ চাষের জন্য উপযোগী। এছাড়া বাড়ির ছাদে টবেও এর চাষ করা যাবে। এই জেলায় সোহেল রানাই প্রথম বেশি সংখ্যক ‘মালবেরি’ গাছ লাগিয়েছেন। নওগাঁতে মালবেরি চাষ যেন আগামীতে বৃদ্ধি পায় সে জন্য আমরা চাষিদের নিয়ে প্রশিক্ষনে উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনা করছি।'