ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বেগম রোকেয়ার স্মৃতি কেন্দ্র
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া জন্মেছিলেন রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস। দিনটি এলেই মহীয়সী বেগম রোকেয়াকে নিয়ে জন্মস্থান রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্তাদের শুরু হয় নানান তদরকী। মাস ভর চলে ধোঁয়া-মোছা, রঙ আর পরিষ্কার করার কাজ বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রে। অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা, সেমিনার আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বক্তৃতায় বেগম রোকেয়ার স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখতে দেয়া হয় নানান প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বাস্তবে তার কোনও প্রতিফলন নেই। এখন ধ্বংস হতে বসেছে রোকেয়ার বাস্তভিটা, স্মৃতি কেন্দ্রসহ বেগম রোকেয়ার সব স্মৃতি বিজরিত চিহ্নগুলো।
বেগম রোকেয়া স্মৃতিকে ধরে রাখা তার জীবনী আর রচনা নিয়ে গবেষণা এবং সুবিধাবঞ্চিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছিল বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় গড়া স্মৃতিকেন্দ্রের আজ বেহাল দশা। ২০ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় নির্মাণকরা বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রটি। আইনি জটিলতা কাটলেও সরকারি উদ্যোগের অভাবে এটি পড়ে আছে অবহেলায়। অথচ নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়ার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তার গ্রন্থাবলির অনুবাদ, প্রচার ও প্রকাশনা, সংস্কৃতিচর্চা এবং স্থানীয় যুবক যুবতীদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে ২০০১ সালে স্মৃতি কেন্দ্রটি চালু করা হয়েছিল। এ নিয়ে মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ বাসীর মনে ক্ষোভ জমে আছে। ৩ একর ১৫ শতক জমির ওপর নির্মিত কেন্দ্রটি দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকায় নষ্ট হচ্ছে আসবাবসহ বিভিন্ন উপকরণ। স্মৃতি কেন্দ্রে একটি আধুনিক মিলনায়তন, সেমিনার কক্ষ, পাঠাগার, সেলাই মেশিনসহ একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে।
আরও আছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিস, কেন্দ্র চত্বরে বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য ও উপ-পরিচালকসহ কর্মচারীদের আবাসন ব্যবস্থা। জনবল-সংকট বিভিন্ন কারণে সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি বন্ধ। কাজে আসছে না মিলনায়তন। পাঠাগার থাকলেও নেই রোকেয়ার জীবন দর্শন জানানোর মতো নেই পর্যাপ্ত বইপুস্তক। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০১ সালে উদ্বোধন করেন।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথমে কেন্দ্রটির দায়িত্বভার নিলেও তিন বছর পর দায়িত্ব পায় এ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলা একাডেমি। ২০১১ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে বাংলা একাডেমির অধীনে স্মৃতিকেন্দ্রটি হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়। পরে বাংলা একাডেমির কাছে হস্তান্তর করা হয়। সাড়ে তিন কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত এই কেন্দ্রটি পুরোপুরি চালুর ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখন পাঠাগার আর কিছু শিক্ষার্থীদের নিয়ে সংগীত ও চিত্রাঙ্কনচর্চা চালু রয়েছে। তবে বেশির ভাগ পাঠকই হতাশ পাঠাগারের বই-সংকটের দশায়।
রংপুরের মিঠাপুকুরের স্মৃতিকেন্দ্র দেখতে এসেছিলেন তিন বন্ধু বগুড়া থেকে। তখন ঘড়িতে বিকেল সাড়ে তিনটা। পাঠাগারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মোস্তাক মিয়া ঢাকা প্রকাশ-কে বলেন, আমরা তিন বন্ধু বেগম রোকেয়ার স্মৃতিবিজড়িত এই জন্মস্থান দেখতে এসেছি। ঘুরে ঘুরে অনেক কিছু দেখলাম। কিন্তু স্মৃতিকেন্দ্রের ভেতরে পাঠাগারের সামনে এসে দরজা বন্ধ পেলাম। অথচ নোটিশ বোর্ডে ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত পাঠাগার খোলা রাখার নোটিশ সাঠানো আছে।
দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান জিনিসপত্র। অত্যাধুনিক অডিটোরিয়ামটির চেয়ারসহ আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হওয়ায় এখন সেলিং ফ্যান ঘোরে না। একই অবস্থা বেগম রোকেয়ার বাস্ত ভিটাতে। এ পর্যন্ত সেখানে কোনও স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি। অযত্মে-অবহেলায় এখন ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে।
মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আগ্রহ আর নির্দেশনায় ২০০১ সালে দৃষ্টি নন্দন স্মৃতি কেন্দ্রের নির্মাণকাজ হয়। দু বছর পর তিনি নিজেই বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। নির্মাণের উদ্দেশ্যে ছিল বেগম রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণা হবে, দেশ-বিদেশের অতিথিরা আসবেন, গবেষণা করবেন কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। এখন স্মৃতি কেন্দ্র এবং বেগম রোকেয়ার বাস্ত ভিটা ধ্বংসের শেষ প্রান্তে।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। সে সময় মুসলিম সমাজে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোন চল ছিল না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও পরিবারের সবার অগোচরে তার বড় ভাইয়ের কাছে উর্দু, বাংলা, আরবি ও ফারসি পড়তে এবং লিখতে শেখেন। তার জীবনে শিক্ষালাভ ও মূল্যবোধ গঠনে তার ভাই ও বড় বোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। পরবর্তীতে বিহারের ভাগলপুরে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়। স্বামীর উৎসাহে ও নিজের আগ্রহে তিনি লেখাপড়ার প্রসার ঘটান। বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মারা যান।
বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রের উপ-পরিচালক ফারুখ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ভবনটির সংস্কারের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে, লাইব্রেরি খোলা আছে প্রয়োজনীয় বইয়ের অভাব রয়েছে।