রংপুরের শতরঞ্জি ৩৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে
রংপুর মহানগরীর উপকন্ঠে সেনানিবাসের পশ্চিমে ঘাঘট নদীর তীরে একটি গ্রামের নাম নিসবেতগঞ্জ, গ্রামটি পরিচিত শতরঞ্জি গ্রাম হিসেবে। নিসবেতগঞ্জের প্রায় বাড়িতেই শোনা যায় বাঁশের তৈরি শতরঞ্জির তাঁতের ঘটাং ঘটাং শব্দ। শতরঞ্জি শিল্পের কারিগররা আপন মনে বুনে চলছেন নানান রকমের শতরঞ্জি।
অষ্টাদশ শতকে বৃটিশ নাগরিক নিসবেত তদানিন্তন রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। সেই সময়ে নিসবেতগঞ্জ মহল্লার নাম ছিল পীরপুর গ্রাম। সেই পীরপুর গ্রামে তৈরি হতো মোট মোটা ডোরাকাটা রং-বে-রংয়ের সুতার তৈরি গালিচা বা শতরঞ্জি। নিসবেত এসব শতরঞ্জি দেখে মুগ্ধ হন। পরবর্তীতে তিনি শতরঞ্জির গুণগতমান উন্নয়ন এবং এ শিল্পের প্রচার ও প্রসার এর লক্ষ্যে সহায়তা দেন। উৎপাদিত পণ্যের ব্যাপক বিপণন ব্যবস্থার বন্দোবস্ত করেন।
এই শিল্পের মান উন্নয়ন ও বিপণন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্যই নিসবেতের নামানুসারে শতরঞ্জি সমৃদ্ধ এ গ্রামটির নামকরণ হয় নিসবেতগঞ্জ। দিন ভর কাজ করলেও মজুরি বৈষম্যের কারণে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তারা। তবুও থেমে নেই। অল্প মজুরিতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা।
ইংরেজির ১৯৭৬ সালে সরকারিভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) নিসবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি তৈরির একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। পরবর্তীতে তদারকির অভাবে ব্যাপক বাজার চাহিদা সৃষ্টি করতে না পারায় ধীরে ধীরে বিসিকের প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে।
পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বিনা পয়সায় আরও উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে এ গ্রামের মানুষদের শতরঞ্জি উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করে। সেই থেকে আর থেমে নেই শতরঞ্জির উৎপাদন। এখন নিসবেতগঞ্জের প্রায় বাড়ির সামনে গেলেই ভেসে আসে শতরঞ্জি বুননের ঘটাং ঘটাং শব্দ । কালের বিবর্তনে বাংলার মসলিন শিল্প হারিয়ে গেলেও, রংপুরের শতরঞ্জি পল্লী এখনো মাথা উচু করে দাড়িঁয়ে আছে।
আধুনিক সভ্যতায় কারু শিল্পের প্রতি মানুষের আকর্ষণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শতরঞ্জির তৈরী কারিগরদের জন্য আর্শিবাদ। এত কিছুর পরেও রংপুরের শতরঞ্জি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার প্রায় ৩৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশেও রংপুরের শতরঞ্জির ব্যাপক চাহিদা। বর্তমানে কারু পণ্য রংপুর লিমিটেড নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে শতরঞ্জি তৈরির পাঁচটি কারখানা। এ কারখানায় প্রায় চার হাজার শ্রমিক কাজ করছেন।
বিসিকের উপ মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ আমজাদ হোসেন জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে রপ্তানি বাণিজ্যে হস্তশিল্পের ৬০ শতাংশই রপ্তানি হয়ে থাকে রংপুরের শতরঞ্জি। বিগত তিন বছরে গড়ে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ ডলার দেশে আনা সম্ভব হয়েছে রংপুরের উৎপাদিত শতরঞ্জির মাধ্যমে। শুধু যে নিসবেতগঞ্জ থেকে যে শতরঞ্জি রপ্তানি হচ্ছে তা নয়। এখন বাড়ি বাড়ি তৈরি হচ্ছে শতরঞ্জি। নগরীর নিসবেতগঞ্জের শতরঞ্জি পল্লী যেন এক বিশাল কারু পণ্যে পরিণত হয়েছে । নিসবেত গঞ্জের অধিকাংশ বাড়ির আঙ্গিনা কিংবা উঠানে টিনের ছাউনির নিচে নিপুন হাতে চলছে সুই সুতোর কারু কাজ খচিত শতরঞ্জি বোনার কাজ। যেখানে আগে হাতির পা, জাফরি, ইটকাঠি, নাটাই ইত্যাদি নামের নকশা সংবলিত শতরঞ্জি তৈরী হত সেখানে এখন আরও বাহারি নকশার শতরঞ্জি উৎপাদিত হচ্ছে ।
সরকারিভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) এর নির্ভর যোগ্য সুত্রে জানাগেছে, নিসবেতগঞ্জ গ্রামে তাদের একটি শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মাত্র দুইটি দলের শ্রমিকদের শতরঞ্জি শিল্পের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তারা বলেছেন, সরকারি বরাদ্দ অপ্রতুল তাই ব্যাপক আকারে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাচ্ছেনা।
রংপুর নগরীর নিসবেতগঞ্জ শতরঞ্জি নামক শিল্পের কারিগর গীতারানী, সৈকত হোসেন, ফারুক হেসেন বলেন, একজন কারিগর দিনে ১৫ থেকে ২০ ফুট শতরঞ্জি তৈরি করতে পারেন। আর এ কাজের মজুরি মিলে মাত্র ১২ থেকে ১৫ টাকা প্রতি ফুট।
তারা আরও বলেন, সরকারিভাবে বাংলাদেশ ক্ষদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) সরকারের বরাদ্দ পেলে কিছু কারিগরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেন। বর্তমানে এই শতরঞ্জি নামক শিল্প চলছে ব্যক্তি মালিকানায়।
রংপুর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সরোয়ার টিটু বলেন, রংপুর নগরীর নিসবেতগঞ্জের এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তার আহ্বান জানাচ্ছি।
রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, মহানগরীর নিসবেতগঞ্জ গ্রামের শতরঞ্জি শিল্পিদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণসহ ঋণ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
কেএফ/