বালির প্রাসাদের রাজা
গেল ২৪ বছর ধরে ব্রাজিলের মার্সিও মিজায়েল মার্তোলিয়াস ভাড়া দেওয়া বাদ দিয়েছেন, কোনো ধরণের বিল দেবার ঝামেলাও তার নেই। এই দিক থেকে তিনি রাজধানী রিও ডি জেনিরোবাসীর সবচেয়ে আকাংখিত প্রতিবেশী হয়ে গিয়েছেন। তারা ভাবেন, আহা তার মতো হতে পারতাম যদি! তবে তার মতো হবার উপায় নেই কোনো। কেননা তিনি যে বাস করেন একটি সাগরের তীরে। সেটি একটি সাগর সৈকত নাম বাহা বাচিজুকা। সেখানে তিনি বালু দিয়ে একাই গড়েছেন একটি প্রাসাদ। সেই বালির প্রাসাদে থাকেন তিনি। বালিয়াড়ির রাজা! বালির প্রাসাদের সম্রাট।
এখন তার বয়স ৪৬। আশপাশের স্থানীয়দের কাছে তিনি ‘রাজা মার্সিও’ বা ‘কিং মার্সিও’। নিজের এই নামকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রাসাদের বাইরে তিনি পরে থাকেন একটি রাজমুকুট। সেটিও তার অর্ডার দিয়ে বানানো। একটি প্লাস্টিকের মুকুট আসলে তা। তবে সোনালী রঙের। হাঁটার সময় তিনি একটি লাঠি। সেটিও কিন্তু স্থায়ী কোনো বস্তু নয়।
রিও ডি জেনিরোর আসল সৈকতগুলোতে নানা ধরণের বর্ণিল বালির প্রাসাদ, বালির নানা ধরণের ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি থাকে। এগুলোর সবই বিনোদন দানের জন্য ও পর্যটকদের আগ্রহ নিরাবরণের জন্য, তাদের ধরে রাখতে। বানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা এগুলোর ছবিও বিক্রি করেন। তবে রিও ডি জেনিরোতে ও সারা ব্রাজিলেই মার্সিওই প্রথম মানুষ যিনি নিজে থাকার জন্য একা হাতে একটি বালির প্রাসাদ বানিয়েছেন। কেবল তাই নয়, একা মানুষ হিসেবে সেখানে বসবাস করে চলেছেন। তবে দীর্ঘকাল ধরে বসবাসের ফলে তিনি নানা ধরণের মানুষের আগ্রহ নিজের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পেরেছেন। অনেক দেশের মানুষ তার খবরগুলো আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন। অনেক রিও ডি জেনিরোর মানুষ ভাড়া বেশি দিতে হয় বলে বাদ দিয়ে তার মতো কোনো এক সৈকতে বালির বাসা বানিয়ে থাকার চিন্তা করেন।
কীভাবে তার শুরু? মার্সিওর জন্ম কিন্তু এই রিও ডি জেনিরো অঙ্গরাজ্যেই। বলেছেন, ‘আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই রাজ্যের দক্ষিণ পূবের গুয়ানাবারা সৈকতে। ফলে সাগরকে ছোটকাল থেকে ভীষণ ভালোবাসি। আমি জীবনভর এই সৈকতগুলোর ধারে বাস করে চলেছি। আমার এই সৈকতের একেবারে সামনের দিকে লোকেরা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে মানুষজন বাস করছে। তবে আমার কোনো বিল নেই, আমি এখানে একটি সুন্দর জীবন যাপন করছি।’
তার বালির প্রাসাদটির দেওয়ালগুলো এবং চূড়াগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সেগুলোতে নিয়মিত পানি দিতে হয় মার্সিওকে। বলাবাহুল্য, বালির প্রাসাদের রাজা একা হাতেই সেসব কাজ করেন। এছাড়াও নানা ধরণের যত্নআত্তি করতে হয় তাকে শহরটির সারা বছরের নানা ধরণের গ্রীস্মকালীন আবহাওয়াকে ঠেকাতে। এর বাদেও তার এই কাজগুলোতে ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতাকে অবশ্যই সম্মান করতে হয়। একটি গ্রীস্মমন্ডলীয় ঝড়ই এসে তার এই বালির প্রাসাদকে মিশিয়ে দিতে পারে সাগরের বালুর জগতে। মোটে কয়েক মিনিটে ভেঙে পড়তে পারে তার এই শখের ভুবন, ভালোবাসার ঘরবাড়ি। আবার শুরু থেকে তাকে বানানোর দিকে ঠেলে দিতে পারে। এবার বলি, এই কাজটি ২০ বছরে কয়েকবার করেছেন। ফলে তিনি এই বালির প্রাসাদকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে নিয়ে যেতে পারেন ও কার্যকরভাবে আবার তৈরি করতে পারেন। এই কাজটি খুব ভালোভাবে শিখে নিয়েছেন। এই করতে, করতে একটি কাজও পেয়ে গিয়েছেন। একটি শপিংমল তাকে চাকরি দিয়েছে। যেখানে মাঝে, মাঝে তাদের প্রয়োজনের সময় দিয়ে তাদের জন্য ছোট, ছোট বালির প্রাসাদ গড়ে দিয়ে আসেন তিনি। তারা সেগুলো প্রদর্শন করেন। বিক্রি বাড়ে অন্যান্য পণ্যেরও। এই কাজের শুরুতেও অন্যদের মতো তারা তার বালির প্রাসাদ দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছেন।
কীভাবে শিখেছেন? একজন বন্ধুর কাছ থেকে ও বই পড়ে। বই পড়া তার সবচেয়ে বড় শখগুলোর একটি। তার আরেকটি শখ হলো, গলফ খেলা অন্যটি হলো সাগরে মাছ ধরা। শেষ কাজটি নিয়মিত করেন। তিনি বই সংগ্রহ করেন। গলফ ক্লাবগুলোতে গলফ খেলতে যান। তার এই বালির প্রাসাদটি বাইরে থেকে দেখতে বিরাট ও সুন্দর। রাস্তার দিকে মুখ করা থাকে। সেদিক দিয়ে ঢুকে ভেতরে আছে তার ছোট্ট ঘর। এই ৩২ স্কয়ার ফিটের ঘরেই থাকেন। মেঝে থেকে মাথার ছাদ পযন্ত এই শখের মানুষটির কটি শখে বোঝাই। বেশিরভাগই হলো বই। বালির প্রাসাদের ওপরের দিকটি কাঠের বিমের। তবে তিনি পাশের লাইফ গার্ডদের কুড়েঘরে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজ ও গোছল করেন।
‘কিং মার্সিও’ নামের এই মানুষটি একজন স্থানীয় তারকা ও তাদের সবার আগ্রহের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। পাশ দিয়ে যাবার সময় পর্যটকরা তার সঙ্গে ছবি তোলেন, তার অন্যরকমের বাড়ির ছবিও ঠাঁই নেয় তাদের ক্যামেরায়। তাদেরকে হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানান, ছবি তোলেন, টাকা পান ও বসতে দেন তিনি। এভাবে তাদের কাছ থেকে উপহার পেয়ে গড়ে তুলেছেন কটি টাকার সঞ্চয়। তবে কখনো চান না কারো কাছে। তার বইয়ের প্রতি ভালোবাসাও সামান্য আয়ের পথ দেখিয়েছে। তার প্রাসাদের সামান্য সামনে তিনি একটি টেবিলে নিজের বইগুলো সাজিয়ে রাখেন। তবে যে টাকাই তারা দেন না হাসিমুখে গ্রহণ করেন। এই বইগুলোর ওপরে তিনি লিখে রেখেছেন-‘একটি বই তুলে নিন ও এই বাক্সে টাকা রেখে সাহায্য করুন, যাতে কোনোদিন উদ্যোগটি থেমে না যায়।’
মার্সিওর এই প্রাসাদের একমাত্র খারাপ দিক তার মতে, যখন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতে প্রচন্ড গরমে পড়ে হয়ে যায়, গরমে ফেটে পড়ে এই সাগরের প্রাসাদ; ভেতরে ঘুমানো অসম্ভব হয়ে যায়। ফলে গরমের দিনগুলোতে তিনি একজন বন্ধুর সঙ্গে থাকেন,। যদিও সাগরের কাছে থাকতে তার ভালো লাগে। কোনোদিনও তিনি তার এই বাড়িটি ছেড়ে যাবেন না বলে জানালেন।