রেলের পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশে কালের সাক্ষী–অদম্য স্বাধীনতা
নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে বড় কারখানাটি। ১৮৭০ সালে স্থাপিত এই কারখানা দাঁড়িয়ে আছে ১১০ একর জায়গাজুড়ে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সংগ্রাম ও গণহত্যার ঘটনায় স্মরণীয় হয়ে রয়েছে কারখানাটি।
একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর স্বাধীনতা আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। সারাদেশের মুক্তিকামী মানুষের মতো নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার শ্রমিকেরাও আন্দোলনে যুক্ত হন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের প্রায় সত্তর শতাংশই ছিলেন অবাঙালি। তাদের একাংশ বাঙালিবিদ্বেষী অবস্থান থেকে ব্যাপক নিপীড়ন চালায়।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ রেল কারখানার মূলফটকের সামনে কারখানার অ্যাকাউন্ট্যান্ট এম এ আজিজকে হত্যা করে জ্বলন্ত বয়লারে নিক্ষেপ করা হয়। এরপর শুরু হয় মুক্তিকামী শ্রমিকদের উপর নজিরবিহীন নিপীড়ন। অনেক শ্রমিক-কর্মচারীকে জ্বলন্ত বয়লার ও ফার্নেসে ফেলা হয়। সৈয়দপুর পরিণত হয় অত্যাচার-লুটপাট, হত্যা-ধর্ষণের শহরে। বহু কর্মচারী শহিদ হন। তাদের চূড়ান্ত তালিকাও তৈরি করা যায়নি।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার সেসব কর্মচারী-শ্রমিকদের আত্মাহুতির সংগ্রামী ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরতে ২০১২ সালে কারখানার তৎকালীন বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক মো. মঞ্জুর উল আলম চৌধুরী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শহিদ সহকর্মীদের জন্য একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেন তিনি।
স্মৃতিসৌধের জন্য নকশা আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে উচ্চমান সহকারী রেজাউল ইসলাম সাজুর নকশা বাছাই করে কারখানা শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বেচ্ছাশ্রমে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্মৃতিসৌধটির নামও আহ্বান করা হয়। শ্রমিক-কর্মচারীদের পাশাপাশি নাম প্রস্তাব করেন মঞ্জুর উল আলম চৌধুরীর স্ত্রী সামছে আকিদা জাহান। শেষ পর্যন্ত তার দেওয়া নাম ‘অদম্য স্বাধীনতা’কেই চূড়ান্ত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, একাত্তরের ২৭ মার্চ স্মরণে ক্ষয়ে যাওয়া রেলের যন্ত্রাংশ দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ সহর্কমীদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করেছেন সেখানকার শ্রমিকরা। ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে তৎকালীন রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক এই স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর সৈয়দপুর কারখানার আধুনিকায়নে নেওয়া চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় কারখানার পরিত্যক্ত ইট, রড, অকেজো লোহার পাত ও রেলের ধাতব সামগ্রী দিয়ে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধটি।
অনেকটা রেলের আদলে নির্মাণ করা ‘অদম্য স্বাধীনতা’র উপরে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা, তার নিচে রয়েছে হাত যা উৎপাদনের প্রতীক। বাঁ দিকে রয়েছে গিয়ার যা গতি ও শক্তি সঞ্চালনের প্রতীক। এর নিচে ইঞ্জিন, গতি ও বাংলাদেশের রেলওয়ের ঐতিহ্যের প্রতীক। একাত্তরে মুক্তিকামী শ্রমিকদের হত্যার পর যে বয়লার ও ফার্নেসে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, সেটিই রাখার চেষ্টা করেছি সৌধের মাঝখানের বয়লার ও ফার্নেসে।
স্মৃতিসৌধটির নিচে ডান পাশে রয়েছে ওয়ার্কশপ শেড, যা যান্ত্রিক কারখানার প্রতীক। এর নিচে রয়েছে রেল কোচ, যা বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীসেবার প্রতীক। স্মৃতিসৌধটি দাঁড়িয়ে আছে সাতটি ধাপের সিঁড়ির উপর। পুরো স্মৃতিসৌধটি একটি উদীয়মান সূর্যের আদলে তৈরি করা হয়েছে, যা স্বাধীনতার নতুন সূর্যের প্রতীক।
২০১৩ সালে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর থেকে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার সব শ্রমিক, কর্মচারী আর কর্মকর্তারা এই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানান। এমনকি যারা এই কারখানা পরিদর্শনে আসেন, সবাই ‘অদম্য স্বাধীনতা’র কাছে যান শ্রদ্ধা জানাতে। দায়িত্ব নিয়ে সৈয়দপুরে কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনও ‘অদম্য স্বাধীনতা’তে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
একাত্তরের গণহত্যার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়েছে। কালের সাক্ষী হয়ে স্মৃতিসৌধটি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামী ইতিহাসকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে আছে। ‘অদম্য স্বাধীনতা’ সেই ইতিহাসকে নতুন করে তুলে ধরছে নতুন প্রজন্মের সামনে।
এসএ/