গরিবের ডাক্তার বুলবুলের স্ত্রী বললেন
‘আমার আর কান্না আসছে না’
রবিবার দুপুর পৌনে একটা। মিরপুর থানার দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষে কম্পিউটারে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কিছু একটা লেখায় ব্যস্ত দুই পুলিশ সদস্য। তাদের পাশেই এক ভদ্র নারীর কোলে একটি শিশুকে নিয়ে বসে আছেন। ফুটফুটে শিশুটি মলিন চেহারা নিয়ে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে কার্টুন দেখায় ব্যস্ত। তার পাশেই আরেকজন
নারী বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত চেহারা নিয়ে বিড়বিড় করছিলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেল, সবকিছু…। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব? বাচ্চা দুটিকে কীভাবে বড় করব। আল্লাহ তুমি আমাকে নিয়ে গেলে না কেন? তুমি বুলবুলকে নিয়ে গেছ কেন? মারবি যখন আমাদের চারজনকে মারলেই তো পারতে।’
এভাবেই বিলাপ করছিলেন শাম্মী আক্তার। সকালে বড় মেয়েকে নিয়ে বাসার কাছেই মনিপুর স্কুলে যাচ্ছিলেন শাম্মী। এর মধ্যেই সকাল সাড়ে সাতটায় দিনাজপুর থেকে তার বাবা মো. ইয়াকুব এর ফোন ’মারে, বুলবুল নাই।’ যেন আকাশ ভেঙে মাথার মাথার উপর পড়ল শাম্মীর। রিকশা নিয়ে প্রতিবেশী এক নারীর সহযোগিতায় দুই সন্তানকে কোলে করে ছুটলেন রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখানে লাশ ঘরে গিয়ে দেখতে পান তার প্রিয় মানুষটির নিথর দেহটি পড়ে আছে স্ট্রেচারে।
সঙ্গে থাকা দুই সন্তান বড় মেয়ে সাত বছরের আফনান আহমেদ আওন ও ১৯ মাসের ছেলে আহরার মেহমেদ সামীও কান্নায় ভেঙে পড়ে। এই দুই শিশু এখনো বুঝতে পারেনি তাদের বাবা আর ফিরে আসবে না।
রবিবার ভোর সাড়ে ৫টায় রাজধানীর কাজীপাড়া মেট্রো স্টেশনের ২৭৮ নম্বর পিলারের কাছে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে মারা গেছেন গরিবের ডেন্টিস্ট (দাঁতের চিকিৎসক) হিসেবে পরিচিত ডা. আহমেদ মাহী বুলবুল।
নিজের ঠিকাদারী ব্যবসার কাজে বোরে বের হয়েছিলেন নোয়াখালী যাওয়ার উদ্দেশে। কিন্তু বাসা থেকে বের হয়ে রোকেয়া সরণিতে উঠেই তিনি দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হন।
দুপুরে স্বামীর লাশ হাসপাতালের হিমঘরে রেখে শাম্মী আক্তার গিয়েছিলেন মিরপুর মডেল থানায় স্বামীর হত্যাকান্ডের ঘটনায় মামলা করতে। সঙ্গে ছিলেন তার মামী আইরিন আর কোলের শিশু সামী। বড় মেয়ে আওন রেখে এসেছেন এক আত্মীয়ের বাসায়।
থানায় বসেই শাম্মী বলছিলেন, ‘আমার আর কান্না আসছে না, চোখের জল শুকিয়ে গেছে। কেঁদে আর কি করব? এখন তো আমার বাচ্চাদের জন্য যুদ্ধ করতে হবে। সকাল থেকে আমার বাচ্চাটা কিছুই খায়নি। ক্ষুধায় ছটফট করছে। বাইরের কিছু খায় না। বাসায় না গেলে কিছু খাওয়াতেও পারব না।’
তিনি বলেন, ‘বুলবুল খুব ভোরে বের হয়েছিল নোয়াখালী যাওয়ার জন্য। সে বের হয়ে যাওয়ার পর আমি সকালে সাতটার দিকে মেয়েকে নিয়ে বের হই স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বাসায় কেউ না থাকায় ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে যাই। কিন্তু রাস্তায় নেমেই ফোন পেলাম বুলবুল নেই।
তিনি আরও বলেন, ‘এটা কোনভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার দুনিয়াটা উলটপালট হয়ে গেল। আমি এখন কোথায় যাব?’
শাম্মী বলেন, বাসায় আমরা চার জনই থাকি। মেয়ে তো প্রতিদিন তার বাবার সঙ্গে স্কুলে যেত। বাবা ছাড়া সে কখনো স্কুলে যেতে চায় না। আজকে বাবা তাকে অনেক বুঝিয়ে তবেই বাসা থেকে বের হয়েছিল।
আর ছেলে তো রাতে বাবা বাসায় না ফেরা পর্যন্ত সজাগ থাকে। বাবার সঙ্গে সে ঘুমায়। এখন তো বাবাকে খুঁজে পাবে না। আমি কী জবাব দেব?
ছোট্ট সামি’র নিষ্পাপ চোখে মুখে অজানা আতঙ্কের ছাপ। তার দিকে তাকিয়ে থাকলে বুকটা ফেটে যায়। বাবা হারানোর বিষয়টি বুঝতে না পারলেও তার জীবনে যে কিছু একটা ঘটে গেছে সেটা সে বুঝতে পারছে। যে শিশু বাসা থেকেই বের হয় না, সে এখন থানায় অসংখ্য মানুষের ভিড়ে। অপরিচিত কাউকে দেখলেই কান্নায় ভেঙে পড়ছে। সে এখনো বুঝতেই পারেনি তার প্রিয় বাবা যার সঙ্গে রাতে খুনসুটি করে ঘুমাতে যায়, সেই বাবা আর ফিরবে না।
এদিকে বুলবুলের স্ত্রী শাম্মী আক্তার বলছিলেন, তার স্বামীকে খুন করা হয়েছে। এমনটাই তিনি মনে করেন। ছিনতাইকারী যদি তাকে মারত তাহলে তো সবকিছু নিয়ে যেত। সঙ্গে থাকা টাকা নেয়নি। বাটন মোবাইল ফোনটি নেয়নি। নিয়ে গেছে শুধু স্যামসং টাচ ফোনটা।
শাম্মী শুধু জানতে চান তার স্বামীকে কারা, কেন হত্যা করল।
এনএইচবি/এমএমএ/