দেশের ৬ হাজার ৭শ রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারিয়ানের ছয় ভাগের একভাগ নারী
বাংলাদেশের একমাত্র উচ্চতম শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সাহস করে গণ বিশ্ববিদ্যালয় ভেটেরিনারিতে অনার্স ও মাস্টার্স চালু করেছে। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ডা. সাবরিনা ফেরদৌস পড়ালেখা করেছেন এই খাতে দেশের একমাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটিতে। তিনি এমএস করেছেন ভেটেরিনারি মেডিসিনে। মেধা ও দক্ষতার গুণে অধ্যাপনা জীবনে আছেন সাভারের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস অনুষদে, মিডিসিক বিভাগে। ক্লিনিক্যাল কোর্সগুলো পড়ান। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ছাত্র-ঢাকা প্রকাশের সাংবাদিক ইহসানুল কবীর আনিন
একজন মেয়ের ভেটেরিনারি বা পশু চিকিৎসা বিষয়ে পড়ালেখা কতোটা যৌক্তিক বলে মনে হয়?
আমাদের মধ্যে কেউ-ই হয়তো কখনো খেয়াল করিনি, এই ভেটেরিনারি শব্দটির মধ্যেই ‘নারী’ শব্দটি আছে। শব্দটি ভাঙলে হয় ‘ভেটেরি’ ও ‘নারি’। ফলে শব্দবন্ধ অনুসারেও ভেটেরিনারি পড়ছে এবং ভবিষ্যতে চাওয়া মেয়েদের জন্য যথোপযুক্ত এবং যুগোপোগী সিদ্ধান্ত। পশু-পাখি পালন, তাদের চিকিৎসা সেবাদানের জন্য ধৈর্য্য ও মমতা প্রয়োজন। নারী মমতা ও সহিষ্ণুতার অপর নাম।
এই বিষয়ে পড়তে গেলে পরিবার ও সমাজের আচরণ, ভাবনা কেমন দেখেছেন?
নিজের কথা বললে, বলাবাহুল্য হবে-আমি আমার পরিবারের কাছে শতভাগ সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছি। কিন্তু এখনো অনেক পরিবার, সমাজ মনে করে, ভেটেরিনারি শিক্ষা মেয়েদের জন্য উপযুক্ত নয়। কোনো, কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক সামর্থ্যকে এই পড়ালেখায় যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মেধাহীন কাজ মনে করে এই খাতকে। তবে সময়ের সঙ্গে, মেধাবী ছাত্র, ছাত্রী এবং শিক্ষকরা চলে আসায় এই শিক্ষা ক্ষেত্রেও চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন হয়েছে, আরো হচ্ছে। হবেও।
নারীদের কর্মক্ষেত্র?
তুলনামূলকভাবে অনেক কম নারী ভেটেরিনারিয়ান আছেন। আমাদের বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিল (বিভিসি)’র ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মোট ৬ হাজার ৭শ রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারিয়ানের মোটে একভাগ নারী। এই চিকিৎসকদের মোট সংখ্যা ১ হাজার ৫শ ৪ জন। তবে তারপরও সব বাধা ডিঙিয়ে তারা ভালো, ভালো পদে কাজ করছেন। প্রাণীসম্পদ অধিদফতর, সরকারি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা ফ্যাকাল্টি হিসেবে, একমাত্র বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতালসহ নানা কাজে যুক্ত আছেন। এসিআই, কাজী ফার্মস, বেঙ্গল মিট, নীলসাগর গ্রুপসহ বাংলাদেশের বড় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করছেন। অন্যান্য বেসরকারী অ্যাগ্রি বিজনেস, ফার্ম, এনজিও, বেসরকারী ভেটেরিনারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরি (ভিডাএস)তে চকরিরত আছেন। তারা সরকারী-বেসরকারী সব প্রতিযোগিতামূলক চাকরি, ব্যাংক, বিশ্বখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি করে চলেছেন। সারা দুনিয়াতেই দিনে, দিনে তাদের ও ভেটেরিনারিয়ানদের কর্মক্ষেত্র বেড়ে যাবে। বলব, আমাদের নারী ভেটেরিনারিয়ানদের সংখ্যা যত বাড়বে, কর্মক্ষেত্রের নতুন দিগন্তও তৈরি হবে। তারা টিকাও তৈরি করছেন।
কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো?
নারী দিবসের এই ক্ষণে জানাব, নারীদের জন্য প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতা আছে। নারী নিজেই প্রাকৃতিকভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। কেননা তারা মা হন ও সন্তানের জন্মদান করেন। সেই সন্তানকে ফেলে রেখে কাজে চলে যান। সারাক্ষণ তার জন্য মন কাঁদে। পশুপাখির মায়ের সঙ্গে এখানেই তাদের মিল। তারা যেমন বলতে পারে না, আমরা নারী মায়েরাও অনেক ব্যথা, দুঃখ বলতে পারি না কারো কাছেই। তবে আমাদের ভেটেরিনারি শিল্পখাতে প্রতিবন্ধকতাগুলো অন্যান্য খাতের চেয়ে বেশি-ই। অনেক পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাঠে, ঘাটে কাজ করতে হয়। পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে সমভাবে এগিয়ে যেতে হয়। মাঠ বা দুর্গম এলাকায়ও পশু চিকিৎসাসেবা দিতে হয়। ইত্যাদি কাজগুলো একসময় অনেক বেশি কঠিন ছিল। এখন অনেকটাই সহজ। সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এগুতে নারী ভেটেরিনারিয়ানদের প্রত্যেকের মেধা, ইচ্ছাশক্তি, সাহস ও দক্ষতা প্রধান নিয়ামক হিসাবে সবসময়ের মতো, সব কর্মক্ষেত্রের হিসাবে কাজ করে।
ভেটেরিনারির সাধারণ কর্মক্ষেত্রে সারা দেশে নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়ে অভিমত?
আমাদের বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভেটেরিনারি ও সংশ্লিষ্ট কর্মক্ষেত্রগুলোতে উচ্চ পদগুলো বাদে নারীরা পুরুষের চেয়ে অনেক গুণ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে আমাদের ওপর আচরণগত বৈষম্য খুব সাধারণ ব্যাপার হয়েছে। মৌলিক সুযোগ-সুবিধাগুলো না পাওয়া ছাড়াও বন্ধুত্বপূর্ণ কাজের পরিবেশটুকু লাভেও আমরা বঞ্চিত হই। ভেটেরিনারি খাতে বাংলাদেশে নারীরা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেন। কবে তারা যথাযথ মর্যাদা লাভ করেছেন? তাদের মর্যাদা প্রদান করা হয় না। কাজে আমাদের পুরুষদের স্বভাবগত প্রাচীন গেঁড়ে বসা ধারণা-মেয়েরা কম কাজ করেন, কাজে ফাঁকি দেন ও অনীহা প্রকাশ করেন। এসব গুরুতর প্রতিবন্ধকতা এবং বৈষম্যের শিকার হয়েও বাংলাদেশের নারী ভেটেরিনারিয়ানরা সবাই সফলভাবে পশুসম্পদের চিকিৎসাসেবা ও প্রাণীদের কল্যাণে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন বলে আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।
ব্যক্তিগতভাবে সংসার, কর্মক্ষেত্র সামাল দেন কেমন করে?
কথায় বলে-যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। আমারও প্রথম দিকে একটু সমস্যা হয়েছে। তবে খুব ভালো ফলাফল করেছি বলে অনেকটা সহজে এগিয়ে যেতে পেরেছি। কর্মক্ষেত্র, ঘরে এখন আর কোনো সমস্যা মনে হয় না। আমার মতে, ঘরের কাজ বা বাইরের কাজ-দক্ষতা, মেধার যথাযথ সমন্বয় করে করলে যেকোনো কাজে সফল হওয়া সম্ভব।
নতুন নারী ভেটেরিনারিয়াদের জন্য উপদেশ?
যেহেতু আমরা কৃষিপ্রধান দেশ, তাই বাংলাদেশে ভেটেরিনারি এডুকেশনের গুরত্ব অপরিসীম। আবহমান কাল ধরে, শত, শত বছরে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের মেয়েরা আমাদের গৃহপালিত ও গবাদিপশুগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ ও লালন পালন করে চলেছেন। এখনো এই দেশের মেয়েরা প্রাণীসম্পদের প্রধান সহায়। তাদের ঐতিহ্য অনুসারে আগামী দিনের ও বতমানের তরুণী ভেটেরিনারিয়ান চিকিৎসক ও কর্মী প্রজন্ম বাংলাদেশের প্রাণীসম্পদ উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তবে ভেটেরিনারি এডুকেশনে তাদের আরো কর্মসুযোগ করে দিতে হবে। তাদের জন্য ‘কোটা’ চালু করা প্রয়োজন। তাহলে দেশ ও দশের ভালো হবে। নতুন যে নারীরা খুব আগ্রহ ও ভালোবাসা নিয়ে ক্যারিয়ার হিসেবে ভেটেরিনারি পেশা বেছে নিয়েছেন, নিচ্ছেন, নেবেন-তাদের বলব, আপনার পরিস্থিতিগুলোকে নিজ মনোবল, বিশ্বাস ও কাজের প্রবল আগ্রহে ভালো এবং উন্নত করে তুলুন। নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।
(৮ মার্চ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা)