সুর্বণার সব অভাব মিটিয়ে দিয়েছে ‘বিদ্যা’
দুই চোখে আলো নেই। পড়েন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। বাবা সুবাস দাস মারা গিয়েছেন দুই মাস বয়সে। মা কল্পনা তাকে আজকে পর্যন্ত এনেছেন। সুবর্ণা রাণী দাসের স্বপ্ন নারী দিবসে লিখে ও ছবি তুলে পাঠিয়েছেন তানভীর তুষার
আমি সুবর্ণা রাণী দাস। সবাই ডাকেন সুবর্ণা। গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ি। ওখানেই থাকি। আমার যখন দুই মাস, তখন বাবা সুবাস দাস মারা গেলেন। ফলে মায়ের কোলে মানুষ। আমরা গরিব। জন্মান্ধও ছিলাম না আমি। তবে দুই চোখে সমস্যা ছিলো খুব ছোটবেলা থেকে। যখন কথাও বলতে শিখিনি, সেই ছোট্ট মেয়েটিকে ঢাকার বিখ্যাত ফামগেটের ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো। রোগাক্রান্ত বাম চোখে অপারেশন করা হলো। হাসপাতালের চোখের ডাক্তার বলেছিলেন, ‘ওর বাম চোখটি ভালো হয়ে যাবে’ কিন্তু সেটি গ্রামে ফিরে আসার পর আস্তে, আস্তে আরো খারাপ হয়ে গেল। যখন একটু বড় হলাম তখন তারা রোগাক্রান্ত ডান চোখেও অপারেশন করতে বললেন। প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হলো। তবে আমার বাধায় পারেননি। তবে এখন ডান চোখটিও প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। রাতের গাঢ় অন্ধকার আর দিনের উজ্জ্বল আলো টের পাই আমি। একেবারে চোখের সামনে কোনোকিছু ধরলে সেটি সামান্য বুঝতে পারি। ফলে আমার এই নারী জীবনে বর্ণিল বিশ্বের রূপরস, গ্রাম শহরের পার্থক্য, মানুষের বিচিত্র ভুবন কোনোকিছুই দেখা হলো না। তবে আমার জীবনে সব অভাব মিটিয়ে দিয়েছে বিদ্যা। জীবন তো আর কারো থেমে থাকে না, যার ভেতরে আগুন জ্বলে। মা কণিকা রাণী দাস হয়েছেন আমার জীবনের সহায়, আমি তার অবলম্বন। একটি গ্রামের মেয়েকে তিনি স্বামীহারা হিন্দু বিধবা মানুষের বাড়িতে কাজ করে, রাত জেগে কাঁথা সেলাই করে, সামান্য দুই একটি হাস-মুরগি অনেক যত্নে পেলে লেখাপড়ার খরচ দিয়েছেন। মানুষের বাসায়, বাসায় কাজ করে মা আমাকে মানুষ করেছেন। জীবনের এই বহু কষ্টের যুদ্ধের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমি ধীরে, ধীরে আজকের জীবনে এসেছি। নানু আমার দুঃখ, কষ্টগুলো ভোলার সাথী হয়েছেন। কত যে সংগ্রাম করতে হয়েছে আমাদের। বাড়ি থেকে আমাদের বিদ্যালয়টি অনেক, অনেক দূরে। যাতায়াত করতে এক থেকে দেড়শ টাকা লাগে রাজবাড়িতেই। মা আমাকে চলতে, ফিরতে পারি না বলে প্রায় সময়ই বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে স্কুলে নিয়ে গিয়েছেন আবার বাসায় নিয়ে এসেছেন। আমিও মনোযোগ দিয়ে মা, নানু আর বন্ধুবান্ধব, শিক্ষকদের সাহায্যে পড়ালেখা চালিয়ে গিয়েছি। জীবনে একটিই স্বপ্ন-‘আমি মানুষের মতো মানুষ হব, বড় মানুষ হব।’ ফলে কষ্ট সয়েছি অনেক। গাড়িতে যতটুকু না গেলেই নয়, সেটুকু গিয়ে বাকি পথটুকু মাকে নিয়ে; কোনো বান্ধবীর সাহায্যে হেঁটে গিয়েছি, ফিরেছি। এভাবে সংগ্রাম করে কলেজে পড়েছি। ভালোভাবে পাশ করেছি। আমাকে খুব সাহায্য করেছে বন্ধুরা, সিনিয়র, জুনিয়ররা। তারা আমার ব্রেইলের লেখাপড়ার সাথী হয়েছেন। মুখে বলে গিয়েছি, তারা পরীক্ষায় খাতায় লিখেছেন। শ্রুত লেখকের সাহায্য নিয়েই ভর্তি হয়েছি গত বছর বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ও প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহীতে। আমার পড়ার ভুবন আলোয় ভরা, কল্পলোকের হাতছানি। আমি বাংলা বিভাগের ছাত্রী। এখন আর কেউ আমাকে অবহেলা করতে পারে না। কেননা, কজন পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে? ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মুস্তাফা নূরউল ইসলামের বিভাগের গল্প এখনো কিংবদন্তী। যেমন হাসান আজিজুল হকের গল্পের ভুবন, সনৎকুমার সাহা, ড. অরুন কুমার বসাকের বিশ্ববিদ্যালয়। তারা এক একজন কিংবদন্তী মানুষ। এখন যেকোনো জুনিয়র, সিনিয়রকে; আমার সঙ্গে জীবনের গল্প জানতে দেখা করা সবাইকে, এই লেখার পাঠকদের বলি-‘যার ইচ্ছাশক্তি আকাশ ছুঁয়েছে, তাকে কোনোকিছুই বাধা দিতে পারে না।’ জীবনের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে খুব ভালোবাসি। ফলে ছোট থেকে জীবনের যন্ত্রণা, ভালোবাসা ও আশায় আমি কবিতা পড়ে চলেছি। অনেকগুলো কবিতা মুখস্ত বলতে পারি। গান পারি ভালো। অভিনয়েও পাকা বলেন অনেকে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের বিরাট ভুবনে নিশ্চয় আমি আমার এই প্রতিভাগুলোরও বিকাশ ঘটাতে পারবো। আশা আছে, এগুলো আমার আয়-রোজগারের পাথেয় হবে। আমাকে আরো চিনবে, জানবে আরো কত, শত মানুষ। তাদের হাসি, কান্না, ভালোবাসা হয়ে উঠবে আমার এই গান, অভিনয় আর আবৃত্তি। আমার রোজগার হবে। ভালোভাবে চলতে পারবো। তবে এখানে ভর্তি হয়ে যেমন বিশ্বজয় করে ফেলেছি, তেমনি তারাও চমকে গিয়েছেন। মানুষ এত মেধাবী ও অদম্য হতে পারে! ফলে তারা জানেন না, টেরই পাননি কোনোদিন-অনার্সে বাংলা বিভাগে ব্রেইলে বই থাকতে হয়। আমাদের বাংলার কবিতা, নাটক, লেকচারের ভুবনে ব্রেইলের বইগুলো থাকলে ভালো। ব্রেইলের বই থাকার প্রয়োজনীয়তা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন টের পেলে আরো ভালো অন্ধ, নানা সংকটের ছাত্র, ছাত্রী তৈরি করতে পারবেন। আমাদের পাঠ্যবইয়ের প্রতি ভালোবাসা গাঢ় হবে। এখনো মেসে থেকে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা করতে হচ্ছে। প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত ছাত্র, ছাত্রীদের জন্য আলাদা হল কোঠা চালু করা প্রয়োজন। তাতে সিট দখল ও মানুষের অবহেলা ভুলতে পারবো আমরা। আমি হলে সিট পেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে আরো ভালো করবো, দ্রুত সিটের প্রয়োজন। আমাদের ভিসি স্যারের সহযোগিতা চাই। লেখাপড়া আমাদের করতে হয় দয়া, দাক্ষিণ্যে। কেউ লিখে দেন, স্যারেরা পড়া ভালোভাবে বলে চলেন। সহযোগিতা করেন সবাই নানাভাবে। অনেক কষ্ট করে অভাবী পরিবারগুলো থেকে মেধার লড়াইয়ে জিতে আমরা ভর্তি হয়েছি। আমি তো একেবারেই পথের কাঙাল। ফলে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিগুলো কম হলেও মওকুফ করতে পারলে খুব ভালো হয়। আমাদের লিফটের দরকার। ক্লাসরুমগুলোর জন্য সিঁডি বেয়ে উঠতে কষ্ট হয় নানা ধরণের প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত ছাত্র, ছাত্রীদের। খুব ভালোভাবে একজন মেধাবী ছাত্রী হিসেবে পড়ালেখা শেষ করবো। এরপর বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ক্যারিয়ারের জন্য মেধার লড়াইয়ে নামবো। হতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এখন অনেক সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ফলে জীবনকে আরো ভালোভাবে জয় করতে পারব, মেধার স্বাক্ষর রাখতে স্বক্ষম হব। নচেৎ হব একজন ম্যাজিট্রেট। সেজন্য বিসিএস পাশ করতে হবে। এই আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন আর আমার জীবনের গল্প যখন এই লেখক আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সাংবাদিক তানভীর তুষার লিখছিলেন, বলেছেন, তিনি কেঁদেছেন। আমি বুঝেছি। ভাইয়া আমাকে বলেছেন, ‘আমার লেখায় ভালোভাবে বিশ্বটিকে তোমার দেখার জন্য উন্নত চিকিৎসার খরচ যোগাতে বিত্তবানদের সাহায্য চাইছো আমি লিখব।’ অসাধারণ সুন্দর রাজশাহী ক্যাম্পাস আর জীবনে ভালো করার জন্য সাহায্য চাই-বিষয়গুলো নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তারের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। স্যার বলেছেন, ‘আমাদের অন্যতম মেধাবী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রী সুবর্ণা রাণী দাস তার চাওয়াগুলো বরাবর লিখিতভাবে পেশ করলে আমার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুবিধা হবে। আমি আশাবাদী, ওর চাওয়াগুলো আমরা পূরণ করে দিতে পারব।’
ওএস।