শ্রমিক ছাড়া অর্থনীতির চাকা অচল
আমরা জানি উনিশ শতাব্দীর আগে কারখানার শ্রমিকদের দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা করে কাজ করানোর প্রচলন ছিল। কিন্তু সেই তুলনায় তাদের বেতন ছিল সামান্য। যা তাদের জীবন ধারণের জন্যে যথাযথ ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে এই অতিরিক্ত শ্রমের বিনিময়ে অল্প পারিশ্রমিকে খাটিয়ে নেওয়া মালিক শ্রেণির এই ভাবধারা ভেঙে চূড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল মে দিবস । আমেরিকা থেকে ধীরে ধীরে চীন, রাশিয়া, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মে দিবসের তাৎপর্য ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজ করার দাবি। সেখানেই ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে বার্ষিক দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। যদিও ভারতে এই দিনটি পালিত হচ্ছে ১৯২৩ সাল থেকে। ভারতসহ মোট ৮০ টি দেশে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে মে দিবসের অসীম গুরুত্ব রয়েছে।
আমার জানামতে, এই আন্দোলন অস্ট্রেলিয়ায় শুরু হয়েছিল সবার আগে। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিকদের নানা রকম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য যেটি প্রযোজ্য কথা তা হলো,আমাদের শ্রমিকদের ছাড়া অর্থনীতির চাকা কিন্তু অচল। এখন শ্রমিক বলতে আমি যেটি বুঝি, আমাদের একদলকে কায়িক শ্রম দিতে হয় অন্যদলকে মেধার শ্রম দিতে হয়। সেক্ষেত্রে শ্রমিক আসলে আমরা সবাই। তবে যারা শারিরীক শ্রম দিয়ে থাকেন আমরা সাধারণত তাদেরকেই শ্রমিক বলে থাকি। যারা বিদ্যার আলোকে কাজ করি তাদেরকে আমরা সাধারণত শ্রমিক বলতে চাই না এবং বিপ্লবটা শুরু হয়েছিল তাদের দিয়েই যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন।
আমি যেটুকু বুঝি, শ্রমিক ও মালিকদের সংগঠনকে গড়তে হলে যেটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় সেটি হলো, শ্রমিক মালিক মধুর সম্পর্ক। শ্রমিকদের অনুভূতি মালিকদের যেমন বুঝতে হবে তেমনি মালিকদেরও বুঝতে হবে। যখন একটি প্রতিষ্ঠানকে আমাদের মনে করবে তখন তারা মন প্রাণ দিয়েই তাদের সর্বোচ্চ পরিশ্রম দিতে চেষ্টা করবে। প্রতিষ্ঠানের আয় উন্নতি কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় তারা সেই চেষ্টাটুকু করবে। মালিকদেরও শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনে ইনটেন্সিভ ব্যবস্থা করতে হবে। লভ্যাংশের একটা অংশ শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ করতে হবে। কাজেই তখন তারা আন্তরিক বেশি হবে এবং নিজেদের শ্রমটা নিবিড়ভাবে দিবে। প্রতিষ্ঠানগুলো যদি বিষয়গুলো নিষ্ঠার সঙ্গে করে তাহলে তাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না। আমি মনে করি, এটি করা গেলে আমাদের শিল্প কারখানার প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো সুন্দর শান্তিপূর্ণ থাকবে এবং পরিবেশ ভাল থাকবে।
আমাদের দেশের মালিকপক্ষ যারা আছেন, যারা পরিবারে শ্রম দিচ্ছেন, পরিবারের ভরণপোষণ সেখান থেকে আসে, একটি পরিবারকে তারা বাঁচিয়ে রাখছে, তাদেরও ভালবাসতে শিখতে হবে। উভয়পক্ষ যখন সেই বোধ থেকে পরিচালিত হবেন ,এগিয়ে আসবেন সেখানে শৃঙ্খখলা বজায় থাকবে। যারা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় থাকবেন তাদের জন্যও সহজ হবে। আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেটি হয় তা হলো, মালিকপক্ষ কোট প্যান্ট পরে বাবু সেজে থাকেন আর শ্রমিকেরা খেটে মরে। এই বিষয়গুলো আমাদের মনে রাখতে হবে। কারণ, প্রকৃতপক্ষে উন্নয়নের জন্য এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রমিকদের যেমন শতভাগ সৎ থাকতে হবে ঠিক একইভাবে মালিকদেরও ভালো-মন্দ দেখার দরকার আছে। একটি প্রতিষ্ঠানে সবাই মালিক সবাই অংশীদার এবং এক পরিবারের সদস্য এমন মনোভাবই হতে হবে। এভাবে গলায় গলায় ও কাঁধে কাঁধ রেখে যদি কাজ করা যায়, তাহলে সে প্রতিষ্ঠান উন্নতি করবে। তাহলেই কেবল মে দিবস পালনের যে প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশে সেটি অর্জিত হবে।
একেএম আতিকুর রহমান: সাবেক রাষ্ট্রদূত