মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে
আমি মনে করি, বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে তাদের মত প্রকাশের ক্ষেত্রে আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা ইত্যাদির দরকার আছে। আমরা লক্ষ্য করছি এর বিরুদ্ধে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এমনকি বইপত্র লেখালেখি নিয়েও দেখা যাচ্ছে সমস্যা হচ্ছে। বইপত্রে কী লিখল, পত্রিকায় কী লিখল, কোথায় কী বলল, এগুলো নিয়েও সারাক্ষণ আতঙ্ক ও নজরদারির মধ্যেও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থা আছে, পুলিশ আছে, সরকারি দলের বিভিন্ন বাহিনী আছে, যেমন— ছাত্রলীগ, যুবলীগ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে যারা সরকারি লোকজন তারা পর্যন্ত সংক্রামকের মতো এসবের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। সুশীল সমাজের জন্য বিষয়টি ভাবনার বিষয়। দেশে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে যাদের কাজই হচ্ছে, স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে না দেওয়া। এখন দেখা যাচ্ছে, ছাত্রলীগ, যুবলীগ তারা এই মামলা করছে। পুলিশ এসব মামলা হমালায় বেশ তৎপর। এগুলো পুরোটাই কার্যত আইন হিসেবে কোনো কাজ করে না। এখানে সবই আদেশ পালনে আজ্ঞাবহ।
আমার কথা হচ্ছে, জনগণ সমালোচনা করবে, পর্যালোচনা করবে, মতামত দেবে। সেখানে মতামতের সঠিক জবাব হলো সঠিক মতামত দেওয়া। সরকার যদি মনে করে যে মতামত সঠিক হয়নি, সেক্ষেত্রে তারা সঠিক মতামত দেবে।
আমরা দেখছি সেখানে কোনো সহিষ্ণুতা নেই বরং চরম অসহিষ্ণু পরিবেশ এবং চরম একটি ভীতিকর পরিবেশ বিরাজমান। সরকারেরতো উন্নয়নের কথা বলার জন্য বহু মানুষ আছে। টিভি, রেডিও, পত্রপত্রিকা সবই আছে, প্রতিদিনই আমরা সরকারের উন্নয়নের গল্প শুনি। সেটির ফাঁকে সাধারণ মানুষের কথা থাকবে তাদের জীবন যাপনের স্বাধীনতা থাকবে।
আমি মনে করি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মূলত মানুষের ডিজিটাল নিরাপত্তাহীনতার আইন। দেশের লুণ্ঠনকারী, দখলদার আর সম্পদ পাচারকারীদের নিরাপত্তার আইন। নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধারা আছে, যেখানে পরিষ্কারভাবে বলা আছে মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না, এমপিদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না, উন্নয়ন প্রকল্পের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না, বিদেশি রাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের উপর ভয়ংকর আগ্রাসনও চালায় কিংবা ক্ষতিকর বিভিন্ন চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তার বিরুদ্ধেও কথা বলা যাবে না।
সুতরাং নিরাপত্তা দিচ্ছে তাদের যারা বাংলাদেশের জনগণের শত্রুপক্ষ। এটা বাংলাদেশের দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী ও লুটেরা গোষ্ঠীর দায়মুক্তির আইন। এমন দায়মুক্তির আইন আরও আছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে, সুন্দরবনসহ প্রাণ বিনাশী একের পর এক প্রকল্প হচ্ছে, ঋণনির্ভর প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলা হচ্ছে—সেগুলো করা হচ্ছে একটি দায়মুক্তির আইন দিয়ে।’
আমি মনে করি, আমাদের পর্যালোচনা থাকবে আমাদের কী কী অর্জন হলো, কী কী সমস্যা হয়েছে, কী কী বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে ইত্যাদি পর্যালোচনা করেইতো মানুষ অগ্রসর হবে এবং সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে।
দেশে গরিব মানুষের অবস্থা ভালো নেই। নিম্ন মধ্যবিত্তরা বেকায়দায় আছে। মধ্যবিত্তদের জীবন যাপনে অনেক কাটছাঁট করতে হচ্ছে। সেসব নিয়ে লেখালেখি হতে পারে। পাল্টা লেখালেখি হতে পারে। কিন্তু জুলুম করা বলতে এই যে অন্যায়ভাবে জনমানুষের উপর অত্যাচার এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আনু মুহাম্মাদ: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আরএ/