অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাই বাজেটের লক্ষ্য হওয়া উচিত
আজ থেকে শুরু হচ্ছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশন। ১লা জুন জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করা হবে। এ বছর সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি বাজেট পেশ করা হবে বলে ইতোমধ্যেই অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এমন এক সময়ে বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে, যখন দেশে চরম মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ-ডলার সংকট, রাজস্ব আদায় কম, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত এবং বছর শেষে জাতীয় নির্বাচন। ইত্যাদি কারণে এ বছর বাজেট হবে বড় চ্যালেঞ্জিং।
অন্যসব বছরের তুলনায় এ বছরের বাজেট কিছুটা চ্যালেঞ্জের হবে। কারণ জাতীয় নির্বাচনের আগে সব সরকারই জনতুষ্টিমূলক বাজেট দিতে চায়। কারণ অতীতে দেখা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে যেসব বাজেট দেওয়া হয়, সেখানে অর্থনীতির উন্নতির তুলনায় জনতুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়ে বাজেট ঘোষণা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তবে এবার আর্থিক অবস্থা ও রাজস্ব ঘাটতির কারণে সে সুযোগ খুব সীমিত। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তগুলো বাস্তবায়নেরও চাপ থাকবে। এ বছরের বাজেটে আইএমএফ’র শর্তগুলো অনেকটা ‘ছায়া’ আকারে থাকবে আইএমএফ’র ঋণ অব্যাহত রাখতে যতটা সম্ভব তাদের শর্তগুলোও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা থাকবে। এজন্য ভারসাম্য রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব আদায় ও অন্যসব বিবেচনায় নিয়ে বাজেট পেশ করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এবারই সামষ্টিক অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আইএমএফ’র শর্ত এবং জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সার্বিকভাবে সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কার যেন সুচিন্তিত এবং স্বচ্ছ হয়। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য আইনের প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া পাচার করা টাকা দেশে আনার সুযোগ বাতিল করতে হবে। আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী কর ছাড় কমাতে হবে। চলতি অর্থবছরের এনবিআর’র শুল্ক-কর আদায়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সার্বিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তিনি। তাই আগামী বাজেট চ্যালেঞ্জের হবে।
আগের নির্বাচনী বছরগুলোতে অর্থনীতি তেমন একটা সংকটের মধ্যে ছিল না। ফলে সেই সময় বড় ধরনের কোনো চাপ তৈরি হয়নি। কিন্তু এবার নির্বাচনকে সামনে রেখে জনতুষ্টির কথা বিবেচনা করে বাজেট করা হলে অর্থনীতির ওপর নতুন চাপ তৈরি করবে বলে মনে করেন তিনি। এই ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য রাখতে হবে। সে করণে অতিরিক্ত খরচ এড়িয়ে চলা। প্রয়োজন নেই এমন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ না করা। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে জনতুষ্টিমূলক বাজেট দেওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত।
দেশে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এ বছরের বাজেটে কী ধরনের প্রস্তাবনা করা হয়, সেটির দিকে সবাই তাকিয়ে আছেন। এদিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার চাপ রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পক্ষ থেকে। কিন্তু ভর্তুকি কমানো হলে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আইএমএফ’র শর্ত বিবেচনায় নেওয়া সত্ত্বেও এ বছরেও সার, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি অব্যাহত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত বাজেটে প্রথমে ভর্তুকি ৮৫ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হলেও পরবর্তীতে বাড়িয়ে ১ লাখ ২ হাজার কোটি করা হয়েছিল।
আইএমএফ সাড়ে ৩ বছরের জন্য দিয়েছে মোট ৩৮টি শর্ত, যার অর্ধেকের কম আগামী অর্থবছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে সুদের হারে করিডর পদ্ধতি তৈরি, রিজার্ভের যথাযথ গণনা পদ্ধতি প্রণয়ন, মুদ্রা বিনিময় হারের একটি দর রাখাসহ কয়েকটি শর্ত পূরণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলোর কিছু বাস্তবায়নের ঘোষণা আসবে আগামী জুন মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়, কিছু আসবে জুলাইয়ে। আইএমএফ’র চাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ।
দেশে বরাবরই বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, কখনোই সেটা পুরোপুরি সফল করা যায় না। এ জন্য দেশের রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থাপনাকে যেমন দায়ী করা হচ্ছে, তেমনি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নানারকম ছাড় দেওয়াকেও দায়ী করা হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনা সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এ বছর আরও বাড়ানোর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আইএমএফ’র শর্তে জিডিপির অতিরিক্ত ০.৫ শতাংশ রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।
ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঘাটতি কমিয়ে আনা আর রিজার্ভ কমে যাওয়া, এসবের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে বাজেটে। বৈদেশিক লেনদেনের ওপর ঘাটতি বড় আকারে বেড়েছে। এজন্য টাকার বিনিময় হারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। টাকার আরও পতন হলে আমদানি করা পণ্যের দাম আরও বাড়বে। গত বছরের এই সময়ে দেশে রিজার্ভ ছিল সাড়ে ৪ হাজার কোটি ডলারের বেশি, এই বছরে সেটি ৩ হাজার কোটি ডলারে এসে ঠেকেছে। এদিকে ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আইমএফ’র শর্তের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং আর্থিক খাতের সংস্কারকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে ব্যাংকিংখাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণও বেড়েছে।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিয়েছে। এ অবস্থায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও অভ্যন্তরীণ সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে বাজেট প্রণয়ন করা উচিত। উচ্চাভিলাষী বাজেট না হওয়াই ভালো। দাম স্বাভাবিক রাখতে নিত্যপণ্য ও কৃষিপণ্যের ওপর কর প্রত্যাহার এবং কৃষি খাতে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে নির্দিষ্ট মাত্রায় স্থির রাখার চেষ্টা আরও বেশি জরুরি। যাতে মানুষ কষ্ট না পায়। এজন্য রিজার্ভ বাড়ানোর ওপরই বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। একইসঙ্গে সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটিও জরুরিভাবে দূর করতে হবে।
ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি
আরএ/