সাক্ষাৎকারে আনু মুহাম্মদ (পর্ব ২)
মূল ধারণা থেকে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূরে
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সম্প্রতি ঢাকাপ্রকাশ’র সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন দেশের শিক্ষানীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম এবং করোনাকালের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহেরীন আরাফাত। আজ প্রকাশিত হলো সাক্ষাৎকারটির দ্বিতীয় পর্ব
ঢাকাপ্রকাশ: আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবকাঠামো বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষাপদ্ধতি, এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা অনেক সময় আমরা শুনতে পাই। কেউ বলছেন–এটাকে আরও পরিশীলিত করতে হবে, কেউ অবকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতি বা অবকাঠামো এই বিষয়গুলো আসলে কী রকম হওয়া উচিত? এ ক্ষেত্রে আমাদের কি কোনো অন্তরায় আছে, যদি থেকে থাকে তাহলে এ থেকে উত্তরণের উপায়টা কী?
আনু মুহাম্মদ: বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার পর উচ্চতর শিক্ষা এবং গবেষণার জায়গা। এখানে সবাই আগ্রহী নাও হতে পারে বা সবার প্রয়োজন নাও হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবে এবং সমাজের যে বিভিন্ন দিকের তাগিদ–বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মানবিক বিভিন্ন দিকে যেমন–ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি নিয়ে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা এবং সেগুলো নিয়ে নতুন ধারণা, চিন্তা এবং সৃষ্টি যোগ করে। শুধুমাত্র ক্লাসরুমে পড়ানো এবং সার্টিফিকেট দেওয়া–এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না। বিশ্ববিদ্যালয় হবে–যেটা আসলে বিশ্বজ্ঞান এবং বৈশ্বিক একটা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা। বাংলাদেশে ষাট দশকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন, শিক্ষকরাও আন্দোলন করেছেন। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন চলে আসছে। পরে দেখা গেল স্বায়ত্তশাসন যে কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালে করা হয়েছিল, এরপর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন দেখা যায়নি।
এখন ৫০টার মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, চারটা বাদে সবগুলোই সরকারি কলেজের কাঠামোর মতো পরিচালিত এবং যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন আছে, সেটাও এখন খুবই পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে। এখন পুরো সিস্টেমটাই এভাবে চর্চা হচ্ছে, সরকারের ক্ষমতা এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের একটা সম্প্রসারণ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারের দৃষ্টিটা হচ্ছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান সৃষ্টির কী হবে না হবে, সেটা আমরা ঠিক করব। জ্ঞানচর্চার বেশি দরকার নাই, আমার দরকার হচ্ছে অনুগত একটা বুদ্ধিবৃত্তিক গোষ্ঠী। যারা সরকারকে সেবা করবে। সরকার যা বলবে সেটাকে সমর্থন করবে, এ ধরনের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী নিশ্চিত করা–এটা হলো এখন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। এটার ফলে যেটা হয়েছে, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এখন খুবই দুর্নীতিগ্রস্ত, যাদের সঙ্গে শিক্ষার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই এবং যাদের প্রধান কাজ হচ্ছে সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। এখন ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ বলে একটা জিনিস আছে। পর্যালোচনার দৃষ্টি কিংবা প্রশ্নের দৃষ্টি–এটা হলো জ্ঞান সৃষ্টির প্রধান মাধ্যম। যেখানে পর্যালোচনার চোখে, সমালোচনার চোখে, প্রশ্নের চোখে বিষয়গুলো দেখা এবং সেটার একটা স্বাধীনতা থাকতে হবে। সেজন্য অ্যাকাডেমিক ফ্রিডম খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি এ রকম হয় যে, সরকারি মন্ত্রণালয়ের একটা সম্প্রসারণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যাদের নিয়োগ করা হচ্ছে, তারা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় যাতে সরকারের অধীনস্ত থাকে সেটার একটা লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করে। সেই লাঠিয়াল আবার ছাত্র সংগঠন যেগুলো আছে, তাদের সন্ত্রাসের মাধ্যমে হলগুলোর মধ্যে একটা বড় ধরনের রাজত্ব কায়েম করে। তার ফলে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক দুদিকেই দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের একটা আধিপত্যের কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণের পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে এবং শিক্ষক যারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায়, তাদের পক্ষেও কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। গত কয়েক বছরে শিক্ষক তার মতপ্রকাশের জন্য জেলে যেতে হয়েছে, ফেসবুকে একটা লাইন লেখার জন্য জেলে যেতে হয়েছে; এ রকম অনেক ঘটনা আমরা দেখি। অনেক শিক্ষক তারা গবেষণা করতে গিয়ে ভাবে–আদৌ এই গবেষণা করা ঠিক হবে কি না; মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে ভাবে–এ মতামত প্রকাশ করা ঠিক হবে কি না! এরকম আতঙ্ক এবং ভয়ের মধ্যে যদি গবেষক থাকে, শিক্ষক থাকে; শিক্ষার্থীরা যদি হলের মধ্যে সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকে–এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হলো না–এটা সরকারের একটা বন্দিশালার মতো।
এগুলোর বাইরে আমরা আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয় দেখছি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মূলত বাণিজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ থেকে তাদের প্রফিট করতে হবে। তারা প্রফিট করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে এবং এটা বেশ লাভজনক–এতটা লাভ হবে, তারা আগে হয়তো ভাবেনি! দেখা যাচ্ছে যে, লাভ বেশি হওয়ার জন্য শিক্ষার্থী বেশি ভর্তি করতে হবে। যে ধরনের ফলাফল প্রকাশ করলে শিক্ষার্থীরা আসবে, যে ধরনের বিষয় রাখলে বাজারে ভালো চলতি হবে, ওই ধরনের বিষয় ও ফলাফলের একটা মিশ্রণ আছে। সে কারণে স্বাধীন চিন্তার জায়গাটা ওইখানেও তৈরি হচ্ছে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বড় অংশ দিয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের বাড়তি আয়ের জন্য, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন পড়াচ্ছে। তার ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সময় নেই। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেক আয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে; কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের যে ভূমিকা থাকার কথা, দায়িত্ব থাকার কথা সেটা হচ্ছে না। এই আয়মুখী, উপার্জনমুখী কিংবা মুনাফামুখী তৎপরতার যে প্রভাব বা বিষ, সেটাতে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও আক্রান্ত হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা দেখতে পারছি, উইকেন্ড, তারপর ইভিনিং প্রোগ্রাম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে। তারমানে শুক্র-শনিবার তাদের জন্য আলাদা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এটার ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে বেশি আগ্রহী। সেখানে নিয়মিত ক্লাস নেন, নিয়মিত পরীক্ষার খাতা দেখেন। তাদের মূল দায়িত্ব যেখানে, সেখানে তাদের ক্লাস নেওয়া, পরীক্ষা নেওয়া, নিজেরা গবেষণা করা, সেটার ব্যাপারে মনোযোগ খুব কম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একদিকে হচ্ছে বাণিজ্যিকীকরণ, আরেকদিকে বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রবণতা–এ দুটো মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখন খুবই বিপর্যস্ত অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ধারণা থেকে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূরে। এটার সমাধান তো আসলে দুইটা জায়গা থেকে আসবে–বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চা যারা করেন, তাদেরকে সোচ্চার হওয়া উচিত যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রক্ষা না করলে তো সমাজই রক্ষা পাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নতুন চিন্তা আসবে, মানুষের পক্ষে, দেশের পক্ষে। যতগুলো ক্ষেত্র আছে সবগুলো ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে চিন্তা, গবেষণায় সেগুলো তৈরি হবে। সেটার বাধাগুলো চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াটা বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের একটা দায়িত্ব। সেখানে আমরা বড় ধরনের একটা ক্রাইসিসের মধ্যে আছি। দেখা যাচ্ছে, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের বড় অংশ এখন এতই আত্মসমর্পিত যে, তাদের গুণ কিংবা অন্যায়কে সমর্থন করার মধ্যেই তাদের ব্যস্ততা বেশি। এটার বড় কারণ হচ্ছে–বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওই প্রবণতাটা তৈরি হয়েছে, সুবিধা কিংবা টাকা-পয়সা উপার্জনটাই যেখানে প্রধান প্রবণতা। সুতরাং তারা ওই নিরাপত্তাটা খুঁজে সরকারের আনুগত্যের মধ্যে। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের মধ্যে ওই কণ্ঠটা তুলতে হবে। যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের বাইরে, তরুণদের মধ্য থেকে এ কথাটা তুলতে হবে। আর দ্বিতীয় হচ্ছে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বাংলাদেশে যা যা প্রয়োজন–পাট থেকে শুরু করে গ্যাস, আমাদের খনিজ সম্পদ, আমাদের বন, আমাদের ইতিহাস, এই অঞ্চলের দার্শনিক চিন্তা, আমাদের সমাজে বিজ্ঞানের চর্চা–সবকিছু তো বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়ার কথা। স্বাস্থ্যখাতে যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে–সরঞ্জাম একটার পর একটা আমদানি করা হচ্ছে। সব নীতিমালা, পরিকল্পনা ঠিক করছে বিশ্বব্যাংক। জ্বালানিনীতি ঠিক করছে জাইকা। আবার এদিকে পাট থেকে পলিথিন আবিষ্কার হলো–সেটা নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নাই। একটা দেশের উন্নয়নের ধারা যদি জনস্বার্থে না হয়–জনস্বার্থে যে গবেষণাগুলো করা দরকার সেটার চাহিদাও সরকারের কাছে থাকে না। সরকারের কাছে প্রায়োরিটি হচ্ছে–দেশি-বিদেশি কিছু গোষ্ঠী, যারা দ্রুত টাকা বানাতে চায় তাদের স্বার্থ রক্ষা করা। তার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার আবহাওয়াটা তৈরি করা, স্বাধীন চিন্তার আবহাওয়া তৈরি করা–সেটার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নাই এবং এখন বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগ চলছে একভাবে; কিন্তু জাতীয় প্রয়োজনের সঙ্গে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নাই। জাতীয় প্রয়োজনে আমি বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতি বলি কিংবা আমাদের অবকাঠামো-স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা বলি, সংস্কৃতি বলি–এগুলোর বিকাশের জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে প্রাণচঞ্চল একটা ক্ষেত্র। সেই জায়গাটা বন্ধ হয়ে আছে। তার মানে এখানে সরকারের ভূমিকাটা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সরকার এবং রাষ্ট্র যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে এভাবেই দেখে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হবে অনুগত, যারা আমার অন্যায়কেও সমর্থন করবে। তাহলে তো এ অবস্থা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তি পাবে না। আর এই পরিস্থিতি নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ তারা যদি সোচ্চার না হয়, তাহলেও এটার কোনো পরিবর্তন হবে না।
ঢাকাপ্রকাশ: পরিকল্পিতভাবে আমরা যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা চিন্তা করি, তাহলে আপনার মতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কী রকম হওয়া উচিত? আমরা যে রকম বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশে দেখছি, এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা আপনি বললেন। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারাটা কী রকম হওয়া উচিত? বিশ্ববিদ্যালয়ের ধরনটা কী রকম হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করছেন?
আনু মুহাম্মদ: প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থাকা উচিত। কয়েক তলা বিল্ডিং নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত নয়। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এমন হওয়া উচিত নয়। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই উন্মুক্ত থাকা দরকার। মাঠ থাকা দরকার। সেখানে ক্লাস রুম এবং এর বাইরে যে জগত–দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটা খোলামেলা পরিবেশ থাকা উচিত। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর শিক্ষার জন্য প্রথম অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত সব বেসিক বিষয়ে। মার্কেট কী চাচ্ছে–এ মুহূর্তে মার্কেট একটা চাইবে, কাল আরেকটা চাইবে, পরশু আরেকটা চাইবে–সে অনুযায়ী তো বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ তো এক জিনিস না। প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কেন্দ্র খোলা যায়; কিন্তু শিক্ষা হচ্ছে নতুন চিন্তার বিকাশ করা। সেজন্য বেসিক যেসব বিষয় আছে, বিজ্ঞান-দর্শন-ইতিহাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতি তো আছেই। এর সঙ্গে সম্পর্কিত হলো–আমাদের প্রাণবিজ্ঞান কিংবা আমাদের দেশে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে তৎপরতা আছে–এই বেসিক বিষয়গুলো মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, আবার একইসঙ্গে দেশের ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেসব বিষয় নিশ্চিত করা দরকার। তৃতীয়ত, সেখানে পরিচালনা ব্যবস্থা এ রকম থাকা উচিত–সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা হলো ‘সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়’।
সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বজনের স্বার্থটা প্রধান থাকা উচিত, সরকারের স্বার্থ নয়। সেখানে লেখাপড়া হবে, জ্ঞানচর্চা হবে, জ্ঞান সৃষ্টি হবে, গবেষণা হবে–সেটা হবে পাবলিক ইন্টারেস্টে। শিক্ষকদের ভূমিকাও থাকতে হবে পাবলিক ইন্টারেস্টের সঙ্গে সম্পর্কিত। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করবে পাবলিক ইন্টারেস্টকে নিশ্চিত করার জন্য। সেখানে ভবিষ্যতে সার্ভিস দেওয়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এখন যতটা সম্ভব এলিয়েনেশন তৈরি করা হয়। সমাজ থেকে সে এলিয়েনেটেড হবে। সে সরকারি কর্মকর্তা হবে কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবে কিংবা ইকোনোমিস্ট হবে–যারা সমাজ থেকে আলাদা এবং তারা সমাজের মধ্যে যে মূল্য সৃষ্টি হবে, তার কিছু উদ্বৃত্ত অংশ ভোগ করবে। এটা থেকে সম্পূর্ণ বের হতে হবে–যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে, সৃষ্টিশীলতার তাগিদ থেকে তারা জ্ঞানচর্চা করবে। সেই জ্ঞানচর্চা তাকে সহায়তা করবে নিজের বিকাশে এবং একইসঙ্গে সমাজের ও জনস্বার্থের প্রয়োজনে। যেহেতু এটা সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়, এটা দায়বদ্ধ থাকতে হবে সমাজের কাছে। সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই দায়বদ্ধ থাকবে সমাজের কাছে, সর্বজনের কাছে। তাকে ট্রান্সপারেন্স হতে হবে, তার নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে হবে খুব ট্রান্সপারেন্ট। মেধা সেখানে সবচেয়ে গুরুত্ব পেতে হবে এবং সেখানে কোনো বাণ্যিজিক তৎপরতা চলবে না। বাণিজ্য যখনই শিক্ষার মধ্যে ঢুকে তখনই শিক্ষা আর শিক্ষা থাকে না। কোনো ধরনের বাণিজ্যিক তৎপরতা, বাণিজ্যিক লক্ষ্য, মুনাফার লক্ষ্য–এটা কোনো শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে না, বিশ্ববিদ্যালয়ও না। তার মানে হচ্ছে–এটার যে ব্যয়, সেটা রাষ্ট্রকে বিবেচনা করতে হবে একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে। এটা সাবসিডি না, ভতুর্কি না। বিশ্ববিদ্যালয়কে ভতুর্কি দিচ্ছি–এটা অনেক সময় সরকারি লোকজন বলে। ভতুর্কির প্রশ্ন নয়, এটা হচ্ছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়। যার মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, প্ল্যান তৈরি হচ্ছে এবং দেশের ভবিষ্যৎ তৈরি হচ্ছে। এখানে যে ব্যয়টা হচ্ছে, সেই ব্যয়টার মধ্য দিয়ে যে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হচ্ছে, তারা একটা দেশের ভবিষ্যত অর্থনীতি, রাজনীতি, অবকাঠামো, প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের যে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ সব কিছুর দায়ভার, দায়িত্ব বহন করবে। সে কথা ভেবেই উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে। তার মানে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সবকিছুই একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত থাকতে হবে। আর সেটা সম্ভব যদি শুধুমাত্র লক্ষ্যটা থাকে–জনস্বার্থে, সর্বজনের স্বার্থে সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করব। সেটাই মুখ্য উদ্দেশ্য থাকবে। এটা কোনো বাণিজ্য না। এখানে কোনো রাষ্ট্রের চোখ রাঙানি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে না।
(চলবে)
এসএ/
সাক্ষাৎকারে আনু মুহাম্মদ (পর্ব ১)