বৃহত্তর ঐক্য নিয়ে হিসাব কষছে বিএনপি!
মুখে বৃহত্তর ঐক্যের তাগিদ দিলেও বাস্তবে নিজস্ব কৌশলেই চলছে বিএনপি। ফলে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজপথ আন্দোলন-সংগ্রামে পাশে চাইলেও এখনই ‘একই ছাতা’র নিচে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি পালনে আগ্রহী নয় দলটির হাইকমান্ড। বরং এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন গঠণসহ ইস্যুভিত্তিক বিষয়গুলো কাজে লাগাতে অনানুষ্ঠানিকভাবে বৃহত্তর ঐক্যে প্রক্রিয়াকে মূলত সরকারকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে নিয়েছে দলটি। সেক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যে গঠনের অতীত তিক্ততায় এবার বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে অনেকটাই 'ধীরে চলো' নীতিতে চলার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
অন্যদিকে বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও আছে নিজেদের কৌশলে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে আদৌ কোনো অর্জন হবে কিনা তা খতিয়ে দেখছে এক দলের এক নেতা বিশিষ্ট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো। বৃহত্তর ঐক্যে গঠন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে চলছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিএনপিসহ সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি দলের নেতাদের সঙ্গে একান্ত আলাপ কালে ঢাকাপ্রকাশকে এমনটাই ইঙ্গিত করেছেন নেতারা।
অবশ্য বিএনপি নেতারা মনে করছে, বিগত দিনে জাতীয় ঐক্যে প্রক্রিয়া তাদের জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না। একারণেই এইবার প্রকাশ্যে জোরালোভাবে বৃহত্তর ঐক্যের কথা বলা হলেও বাস্তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর উদ্যোগে কিছুটা সময় নেওয়া হচ্ছে। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে চা-চক্র টেবিল আলোচনা চলমান রাখা হয়েছে। কেননা বিএনপির রাজনৈতিক অনেক এজেন্ডা ও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক এজেন্ডা এক নয়। তাই আপাতত সরকারকে চাপে রাখতে জোটের বাইরে থাকা দলগুলো পৃথক মঞ্চ থেকে কর্মসূচি পালন করা ইতিবাচক বলে মনে করছে দলটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সখ্যতা, রাজনীতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি, বিদেশে নির্বাসিত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সেই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা কার্যকর ঐক্যে গঠনে একই প্লাটফর্মে আদৌ মিলিত হবেন কিনা সেই অবিশ্বাস-সন্দেহ থেকে যায়। তাই বৃহত্তর ঐক্যে প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত রূপ নিয়ে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বাইরে থাকা সরকারবিরোধী বেশকয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইতিমধ্যে প্রাথমিকভাবে বৈঠক করে যাচ্ছে বিএনপি নেতারা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারকে বিদায় করার বিকল্প নাই। সবার দাবি এখন নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। এই ইস্যুতে আমরা বৃহত্তর ঐক্যে গড়ে তুলতে চাই। ইতিমধ্যে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। খুব শিগগিরই সরকারবিরোধী সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক করা হবে। দ্রুত সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যে গড়ে তোলে সংঘবদ্ধ হতে হবে। বৃহত্তর ঐক্যে গঠনের মাধ্যমে রাজপথ আন্দোলন-সংগ্রামে এই অনির্বাচিত সরকারকে বিদায় করতে বাধ্য করতে হবে। কে বাম কে ডান, কোন দল বড় কোন দল ছোট, কে কোন মতাদর্শের রাজনীতিতে বিশ্বাসী সেটা বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হচ্ছে, যার যার অবস্থান থেকে বৃহত্তর ঐক্যে গড়ে তোলতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া। সেই লক্ষ্যে বিএনপিও তার রাজনৈতিক কার্যক্রম ধাবিত করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতিমধ্যে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শেষ করা হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর কয়েকজন নেতা ঢাকাপ্রকাশকে জানান, মূলত সরকারবিরোধী একটি কার্যকর রাজনৈতিক জোট কিভাবে গঠন করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। তবে কোনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি। বেশকিছু বিষয় উঠে এসেছে, সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়গুলো প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একটি কাঠানো দাঁড় করাবে, তারপর প্রতিবেদন আকারে একটি রুপরেখা তৈরি করা হবে। সর্বসম্মতিক্রমে পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় সময় মতো তা প্রকাশ করা হবে। ফলে এখনই বৃহত্তর ঐক্যে প্রক্রিয়া কিংবা রাজপথ আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক জোটের ঘোষণা হচ্ছে না। তবে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এতটুকু বুঝা যাচ্ছে যে, সমালোচনা-আলোচনা যতই হোক না কেন পুরনো জোটমিত্র জামায়াতকে ছাড়বে না বিএনপি। দলটির কাছে রাজপথের শক্তি ও ভোটের হিসাবে তাদের নির্ভরযোগ্য ভোটসঙ্গী-জোটসঙ্গী জামায়াত ইসলামী।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘বর্তমানে যে লড়াই সেটা একা কোনো শক্তির লড়াই না। দেশে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সরকারের পদত্যাগ দাবি, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় প্রশ্নে আমাদের সবাইকে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য, প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে সমন্বিত যুগপৎভাবে শক্তিগুলোকে রাজপথে দাবি আদায়ে অবস্থান নিতে হবে। মানেই হচ্ছে- আমরা তাদের সঙ্গে এক জোট এক মঞ্চ করছি বিষয়টা এমন নয়। তবে যেহেতু কিছু ইস্যু আছে যা কমন সেই সব ক্ষেত্রে রাজপথে সমন্বিতভাবে একসঙ্গে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে।’
একপ্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে বৃহত্তর ঐক্যে নিয়ে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে ইনফর্মাল কথাবার্তা হয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ কে বলেন, ‘আমরা যুগপৎ আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। যার যার অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব হচ্ছে বিষয়গুলো এক টেবিলে নিয়ে আসার ব্যাপারে চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচ্য বিষয়বস্তু মূল্যায়ন, পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কারণ নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে বৃহত্তর ঐক্যে প্রক্রিয়াকে সাংগঠনিক রূপ দিতে কিছুটা হোমওয়ার্ক করতে হয়, কিছুটা সময় লাগে। তাড়াহুড়া করলে কিছু কার্যক্রমে সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে প্রাথমিক আলোচনায় আগামীদিনে বৃহত্তর ঐক্যে গঠনে একসঙ্গে পথ চলার অঙ্গিকার নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে আগ্রহী সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।’
এদিকে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘আমরা দেশে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘদিন ধরে একটি বৃহত্তর ঐক্যে গড়ে তোলার কথা বলে আসছি, এখন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো বৃহত্তর ঐক্যের কথা বলছেন, এগিয়ে আসছেন, এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। তবে সেই লক্ষ্যে পৌছাতে মূলত মানুষের মধ্যে একটি সাধারণ লক্ষ্য সৃষ্টি করতে হবে। সেই সাধারণ লক্ষ্য কেবল একটা ভালো নির্বাচন না, বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা, যাতে করে নিদিষ্ট সময় শেষে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি পথ সৃষ্টি হয়, সেটি জনগণের হাতে থাকে। আর সেটা করতে গেলে বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, অন্তর্বতীকালিন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সাংবিধানিক যে স্বৈরতন্ত্র কায়েম আছে সেখানে একটি ব্যাপক…. সাংবিধানিক সংস্কারে রাজনৈতিক ঐক্যেমতে পৌছাতে হবে।’
তিনি বলেন, আমরা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আছি। বড় বিষয় হচ্ছে- যার যার অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলন সংগ্রামে সবাই ঐক্যমতের ভিত্তিতে একই দাবিতে যুক্ত আছি কিনা? তবে একটি কথা স্পষ্ট আমরা কোনো বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসাতে আন্দোলন করছি না। আন্দোলন হবে এক দফা, সেটা হচ্ছে নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা।’
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি দাবি, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। তারপর নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন। সেটা বিবেচনায় রেখেই এবার রাষ্ট্রপতির সংলাপ ও নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির আলোচনায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছে। বিএনপি ছাড়াও সরকারবিরোধী বেশকয়েকটি রাজনৈতিক দলগুলো বিএনপির সেই পথ অনুসরণ করায় দলগুলোর ভূমিকা কী হবে, সে প্রশ্ন উঠে এসেছে। অন্যদিকে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন প্রক্রিয়ায় ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে, ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে সেই নামগুলো পেশ করা হবে।
সম্প্রতি বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘আমরা অতীতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিলাম, এখন আবার বৃহত্তর ঐক্যে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, দেখা যাক কী হয়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতা ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, শেষ বলে কিছু নেই, রাজনীতিতে অনেক কিছু সম্ভব। আপনি (প্রতিবেদক) যে রাজনৈতিক দলকে (জামায়াত) আলোচনায় টেনে এনেছেন সেটা আপনার জ্ঞাথার্তে সবাইকে বলছি- ওরা কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল নয়, যে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা যাবে না, আন্দোলনে পাশে থাকতে পারবে না। তাদের নিয়ে যদি এতোই সমস্যা তাহলে অনির্বাচিত সরকারের তো অনেক ক্ষমতা, তারা অনেক কিছুই করছেন, করতে পারেন? তাহলে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসাবে নিষিদ্ধ করছেন না কেন? অতীতে কিন্তু তাদের সঙ্গে ছিল, উভয়ের একসঙ্গে আন্দোলনের নজির রয়েছে। তাহলে বিএনপির সঙ্গে সখ্যতা দোষের কী?
আগামীদিনে জোটে থাকা না থাকা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম শরীক জাতীয় পার্টি (এরশাদ) চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন এখন প্রহসনে পরিণত। নির্বাচনের প্রতি মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। তাই আগামী দিনে জাতীয় পার্টি কোন জোটে থাকবে নাকি এককভাবে থাকবে, নির্বাচন করবে সেই সিদ্ধান্ত পরিস্থিতি বলে দিবে।
গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের ট্রাস্ট্রিবোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, নির্দলীয় সরকার ছাড়া আইনের শাসন, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। কোনো দলীয় সরকার এগুলো প্রতিষ্ঠা করবে না। সমাধান একমাত্র জাতীয় সরকার কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা, সে জন্য একটি বৃহত্তর ঐক্যে গঠন করে রাস্তায় নামতে হবে। দলীয় সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে।
এমএইচ