অবহেলায় মৌলিকতা হারাচ্ছে বাংলা ভাষা
ভাষা সংস্কৃতির প্রাণ, ধারক, বাহক। ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল স্বাধীনতা, অসাম্প্রাদায়িকতা ও গণতন্ত্রের বীজমন্ত্র। যে ভাষা অর্জনে এত ত্যাগ, এত প্রাণের খরচ, তার চেতনা বাঙালি ধারণ করতে পেরেছে কতটুকু। তথাকথিত শহুরে স্মার্টনেসের ঢেউয়ে নড়বড়ে হয়ে গেছে বাংলা সংস্কৃতির খুঁটি। অবহেলায় মৌলিকতা হারাচ্ছে বাংলা ভাষা। নতুন প্রজন্ম ঝুঁকে পড়েছে ইংরেজি, হিন্দি, আরবিসহ বিদেশি ভাষার দিকে।
বিকৃতির এ অপসংস্কৃতি থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে হলে শ্রেণিকক্ষ থেকেই প্রকৃত সাংস্কৃতিক শিক্ষা দিতে হবে বলে মত দিয়েছেন সাহিত্যিক, গবেষক ও সংস্কৃতিকর্মীরা। এক্ষেত্রে বহুমুখী শিক্ষা পদ্ধতিও দায়ি বলে মনে করেন তারা।
সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলনে রাষ্ট্রীয় গাফিলতি বলেও উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা। প্রাতিষ্ঠানিক ও উচ্চ শিক্ষায় বাংলার প্রচলনেরও উপর জোর দেন তারা। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গেও বাংলা ভাষা সম্পৃক্তের দাবি জানান ভাষা গবেষকরা।
এ প্রসঙ্গে সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা ও বিদেশি ভাষা মিশিয়ে মনের ভাব প্রকাশ অপসংস্কৃতি ও রুচির বিকৃতি। ভাষার প্রতি যাদের দখল, ভালোবাসা নেই, তারাই শহুরে স্মার্টনেস দেখানোর জন্য বাংলার মধ্যে টুকরা টুকরা বিদেশি ভাষা ব্যবহার করেন।
তিনি বলেন, ‘যতদিন আমাদের শিক্ষা ঠিক পথে না আসবে ততদিন ভাষা বিকৃতির এ ঢেউ বাড়তে থাকবে। এটি তখনই ঠেকানো সম্ভব হবে, যখন আমরা শ্রেণিকক্ষ থেকে প্রকৃত শিক্ষা, সাংস্কৃতিক শিক্ষা দিতে পারব।’
সর্বস্তরে বাংলার প্রচলনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সরকারের সদিচ্ছার অভাবের কথাও বলেন এই সাহিত্যিক। তিনি বলেন, ‘উচ্চ শিক্ষায় আমরা বলি বাংলা ভাষার প্রচলনের জন্য। কী করে হবে! উচ্চ শিক্ষায় তো বাংলা ভাষার পাঠ্যবই পড়ি না। ইংরেজি ভাষা বা অন্য কোনো ভাষা থেকে অনুবাদ করতে হবে। কিন্তু সেই সক্ষমতা আমাদের আছে কী? ভুল বা নিম্নমানের অনুবাদ পড়ার চেয়ে না পড়াই ভালো। প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত উচ্চমানের শিক্ষা দিলে তবেই সম্ভব। আর এ জন্য তো কয়েক হাজার অর্থাৎ বিষয়ভিত্তিক অনুবাদক দরকার। যেখানে কাজ করা দরকার সেখানে কাজ করা হচ্ছে না।’
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্য়ালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘৮০ শতাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম ইংরেজিতে। গণমাধ্যমেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সহজ বাংলা শব্দের পরিবর্তে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে। মাতৃভাষাকে ভালোবাসার অর্থ হলো মাকে ভালোবাসা। যে মাতৃভাষাকে ভালোবাসে না, সে মাকেও ভালোবাসে না, দেশকেও ভালোবাসে না। তাই ভাষাকে ভালো না বাসলে সংস্কৃতিকে ভালোবাসাও সম্ভব নয়।’
উচ্চশিক্ষায় বাংলার প্রচলনের জন্য একটি সমৃদ্ধ জাতীয় অনুবাদ সেল গঠনের উপরও জোর দেন তিনি।
বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘৫২’র ভাষা আন্দোলনের দাবি ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার প্রচলন করা। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত বিষয় ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ৫২ সালে যেমন সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের দাবি ছিল, তেমনি এখনো আছে। কিন্তু আমরা সেটি আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এর প্রধান কারণ, আমরা বাংলাকে ভালোবাসি না। বিদেশি ভাষার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হই এবং ব্যাপক আগ্রহী হই। এ ছাড়া যতক্ষণ পর্যন্ত কর্ম, বৃত্তি, চাকরির সঙ্গে মাতৃভাষাকে সম্পৃক্ত করতে না পারবেন, ততক্ষণ বাংলাকে সর্বস্তরে চালু করা সম্ভব নয়।’
এ ছাড়া বিশ্বায়নের যুগে ভাষাকে তথ্যপ্রযুক্তিবান্ধব করে তুলতে না পারলে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন সম্ভব নয় বলে মনে করেন এ ভাষা গবেষক। তিনি বলেন, ‘সরকারের সদিচ্ছা থাকা দরকার। মূল উদ্যোগটা সরকারকেই নিতে হবে।’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘একটি দেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত একমুখী শিক্ষা পদ্ধতি থাকা খুবই দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে শুরু থেকেই তিন ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি দেখি। বাংলা, ইংরেজি ও মাদরাসা মাধ্যম। স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা, আরবি ও ইংরেজি তিন ভিন্ন সংস্কৃতির অনুসারী হবে শিক্ষার্থীরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, প্রতিষ্ঠানের নামকরণের ক্ষেত্রে বাংলা না রাখলেও তো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি আদালতের রায় বাংলায় পড়া হচ্ছে না। সংবিধানে বলা আছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। অথচ আদালত রায় পড়ছে ইংরেজিতে, শুনানি করছে ইংরেজিতে। এক্ষেত্রে আমি যদি বলি আদালত সংবিধান লঙ্ঘন করছে, আমার অধিকার খর্ব করছে, তাহলে কী ভুল হবে? এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ভাবেই উদ্যোগ নিতে হবে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের অধ্যাপক স্বরোচিষ সরকার প্রাতিষ্ঠানিক ও উচ্চ শিক্ষায় বাংলার প্রচলনের ক্ষেত্রে অনুবাদের ওপর জোর দেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলনে।’
২১ কেবল শোকের নয়, উদযাপনেরও
কুয়াশা ভেজা মেঠো রাস্তায় খালি পায়ের প্রভাতফেরী আর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ২১ শতাংশ মূল্যছাড়। সময়ের ব্যবধানে বদলে গেছে উৎসব উদযাপন ও চেতনা ধারণের ধরন। সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি ২১ শে ফেব্রুয়ারি। কখনো কখনো ফিকে হয়েছে চেতনার রং। ভোগ্য পণ্যের দোকানে শহিদের রক্তের রং দিয়ে তৈরি হয় কেক। দোকানে দোকানে চলে ২১-এর মূল্যছাড়। প্রভাতফেরী, শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, স্মরণিকা প্রকাশ, দেওয়াল লিখন ছিল ২১ উদযাপনের অন্যতম প্রকাশ।
১৯৫২ সালের এ আন্দোলন শুধু মাতৃভাষা বাংলার দাবিতেই ছিল না, এটি মূলত বাঙালির স্বাধীনতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের আন্দোলন- এমনটিই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজমন্ত্র নিহিত ছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই।
অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন অনেকেই, সেজন্য এটি শোকের। ৮০‘র দশকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরীর মিছিল হতো, সংকলন প্রকাশ হতো, একুশের গান হতো। সেগুলো এখন আর তেমন দেখা যায় না।’
একই কথা বললেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ। তিনি বলেন, ‘এমন কোনো ছাত্র সংগঠন ছিল না, যারা সেই সময় একুশে ফেব্রুয়ারিতে স্মরণিকা প্রকাশ করত না। একুশে ফেব্রুয়ারির সেই স্মরণিকা ছিল নতুন লেখকদের আত্মপ্রকাশেরও একটি প্রস্তুতিপর্ব।’
এক সময় ২১ শে ফেব্রুয়ারি বা শহিদ দিবস পালনের মধ্যে অনেকটা শোকের আবহ ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির পর তা উদযাপনের ক্ষেত্রে খানিকটা ভিন্নতা এসেছে। ২১ উদযাপন নিয়ে এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা মতবাদও। এক সময় জাতীয় শোক দিবস পালন হলেও এখন একুশ উদযাপন হচ্ছে খানিকটা ভিন্ন আমেজে। ভাষা বিশেষজ্ঞ, সাহিত্যিক, লেখক, গবেষকরা বলছেন, একুশ কেবল শোকের নয়, উদযাপনেরও। যে অর্জন আসে বহু প্রাণ খরচের বিনিময়ে, তাতে শুধু শোকই থাকে না। থাকে গর্বের, উদযাপনেরও অনেক কিছু।
বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর অনেকটা পাল্টে গেছে শহিদ দিবস পালনের ধরন। তার আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল কেবল আমাদের বিষয়। কিন্তু এখন তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এটির একটি আলাদা তাৎপর্য তো রয়েছেই। ভাষা আন্দোলন আমাদের গর্বের বিষয়। আনন্দের বিষয়।’
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘যে মৃত্যু জীবনের চেয়ে অনেক বড় কিছু অর্জন করে সে মৃত্যু তো উদযাপনেরও। অনেক বড় একটি জীবনের সন্ধান দেয়, তাই শহিদদের মৃত্যু উদযাপনেরও হয়। শহিদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের মৃত্যু তো উদযাপনেরই। তবে উযদাপন মানেই উৎসব নয়।’
তিনি বিজয় দিবস উদযাপনের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেটি তো লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়েই পাওয়া, সেটি আমরা উদযাপনই করি।
স্বরোচিষ সরকার বলেন, ‘শুধু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ার কারণেই ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপনের বিষয় নয়। ভাষা আন্দোলনে আমরা শহিদদের হারিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে তো ভাষা আন্দোলনের চেয়ে বেশি মানুষ শহিদ হয়েছেন। তারপরও তো আমারা স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি। ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আমরা বাংলা ভাষাকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পেরেছি, আমাদের নতুন পরিচয় পেয়েছি এবং ভাষার সঙ্গে আত্নমর্যাদা জড়িত। তাই আমি একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের বিষয় মনে করি। এতে কোনো দোষ দেখি না।’
ভাষার কোনো ধর্ম নেই। অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও আত্মমর্যাদার অবিচ্ছেদ্য অংশ ভাষা। তাই বাংলা সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হলে মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে ও শ্রদ্ধা করতে হবে। তাতেই পূর্ণ বিকাশ সম্ভব সংস্কৃতির।
এসএন/জেডএকে/এসএ/