‘এডিটর’স টক’ অনুষ্ঠানে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন (১ম পর্ব)
অযোগ্যদের উপাচার্য বানানোর ফলে ক্যাম্পাস আক্রান্ত হচ্ছে
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদ। জন্ম বগুড়া জেলার সূত্রাপুরে ১৯৪৭ এর ৫ নভেম্বর। বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ৬৩-তে এসএসসি এবং বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। কলেজ জীবন থেকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বাংলা একাডেমির সবেক মহাপরিচালক ছিলেন। শিক্ষা ও গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৯ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। ২০১৮ সালের ১ মার্চ থেকে তিনি বিইউপিতে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ঢাকাপ্রকাশ-এর এডিটর’স টক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছেন ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। ঢাকাপ্রকাশ-এর প্রধান সম্পাদক মোস্তফা কামালের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে তার ছেলেবেলা থেকে জীবনে এগিয়ে চলার কথা। আজ প্রকাশিত হচ্ছে আলাপচারিতার প্রথম পর্ব।
মোস্তফা কামাল: আমাদের অনুষ্ঠানে আসার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এ অনুষ্ঠানে যারা অতিথি হয়ে আসেন, আমরা তাদের প্রোফাইল নিয়ে অর্থাৎ শৈশব, কৈশোর শিক্ষাজীবন এবং কর্মজীবন নিয়ে আলোচনা করে থাকি। আপনি এ দেশের একজন সুপরিচিত মানুষ। আপনি একজন শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদ, লেখক, বিশ্লেষক; আপনি সম্পাদকও ছিলেন একটি জাতীয় দৈনিকের। অনেক গুণের অধিকারী আপনি। এই প্রজন্ম হয়তো আপনার সম্পর্কে তেমন জানে না। তাদের জন্যই আজকে আমরা জানব আপনার ছেলেবেলা, শিক্ষাজীবন এবং কর্মজীবন সম্পর্কে।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: ধন্যবাদ। আমি কোনো বিদও নই, কোনো গুণের অধিকারীও নই। আমি একজন নগণ্য বাঙালি এবং ইতিহাসের মানুষ। আমার জীবনটা প্রায় সাড়ে সাত দশকের জীবন। ৭৫-এ পা দিয়েছি। আমার জন্ম হয়েছিল বগুড়া জেলার সূত্রাপুরের পৈত্রিক বাড়িতে ১৯৪৭ এর ৫ই নভেম্বর। তবে জন্মক্ষণটি বেশ চমকপ্রদ। রাত ২টায় আমার জন্ম এবং অমাবশ্যার রাতে। পরিবারের লোকজন বলেছিল, এই ছেলের ভবিষ্যত অমাবশ্যার মতোই অন্ধকার। এখনো হয়তো অন্ধকারেই আছি তবে আলোর প্রত্যাশী।
ছোটবেলায় স্কুলে কয়েক ক্লাস পড়া হয়নি। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে গাইবান্ধায় আমাদের ভাড়াবাড়ির পাশেই ছিল জমিদার বাড়ি। তিনি প্রয়াত এবং তার স্ত্রী জমিজমা সব দেখাশোনা করতেন। আমি তাকে মাসিমা ডাকতাম। তার প্রতি আমার খুব আকর্ষণ ছিল কারণ, ছোটবেলায় তিনি আমাকে মিষ্টি দিতেন। তিনটি খাবার আমার তখন খুব প্রিয় ছিল। ফল, মিষ্টি, আচার। এখন মধুরোগে আক্রান্ত, তাই মিষ্টি খেতে পারি না। তবে ফল এবং আচার এই দুটি টিকিয়ে রেখেছি। যা-ই হোক, একদিন মা অভিযোগ করলেন, আপনি ওকে এত আদর করেন, কিন্তু ওতো দূরন্ত, লেখাপড়া করে না। তারপর দুই পয়সা দামের শিশু শিক্ষা দিয়ে আমার শিক্ষাজীবন শুরু। বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ৬৩-তে এসএসসি পাস করি। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করি বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ থেকে। এই কলেজ আমাকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রেখেছিল, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষা পাস করি।
মোস্তফা কামাল: আপনি কি ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হলেন?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: হ্যাঁ। কারণ ইতিহাসকে আমার কাছে মনে হয়েছে সব শাস্ত্রের জননী। সবচেয়ে ভালো লেগেছে আমার কাছে যে, ইতিহাস সত্যলগ্ন। অর্থনীতিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকলেও ইতিহাস বেছে নিলাম। আজকে মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগ যেটি সেখানেই আমাদের কলা বিভাগ ছিল। আমার প্রথম ক্লাসের অভিজ্ঞতাও বেশ রোমাঞ্চকর। যা-ই হোক, প্রথম বিভাগে স্নাতক পাস করলাম।
মোস্তফা কামাল: শিক্ষক কেন হলেন?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: বগুড়া আজিজুল হক কলেজে পৌরনীতি পড়াতেন আমাদের এক শিক্ষক। তাকে দেখেই আমার আকর্ষণ জমে গেল এবং মনে হলো–আমাকে তো শিক্ষক হতে হবে। স্যার খুব পছন্দ করতেন আমাকে।
অনার্স পরীক্ষা দেওয়ার আগেই একটি ঘটনা ঘটল। সুর্যসেন হল থেকে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল। পরে জামিন নিয়ে পরীক্ষা দিই। বাংলা একাডেমিও আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো–বিধাতা কত রসিক! সেই বাংলা একাডেমিতে আমি মহাপরিচালক হলাম। যা-ই হোক, জামিন নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। ফলাফল ভালোই হলো। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। স্নাতক পর্যায়ে গিয়ে আধুনিক ইতিহাস পড়লাম। আজও মনে করি যে, একটি সমৃদ্ধ সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। তখন আমাদের উপাচার্য ছিলেন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী। অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয় মানুষ। জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যে অতুলনীয়। চাকরির ভাইভায় আমি বললাম, আমি যদি এই চাকরিটি পাই, অবশ্যই করব। ফিরে এসে দেখলাম, আমার চাকরি হয়ে গেছে। বেতনের চেয়ে ছয়টি ইনক্রিমেন্ট বেশি পেয়েছি বলে দু-দুটি মিষ্টি খেতে হয়েছিল। একটি চাকরির জন্য অন্যটি ইনক্রিমেন্টের জন্য। সে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা ছিল আমার জন্য।
মোস্তফা কামাল: শিক্ষাজীবনের দীর্ঘ সময়ে মজার কোন অভিজ্ঞতা কি মনে পড়ে?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: আমার সবচেয়ে সমৃদ্ধ সময় কেটেছে ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন থেকে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত। পরে যখন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে আমি রেস্টুরেন্টে কাজ করতাম। এক আমেরিকান ছেলে বেড়াতে এসেছে। আমি তাকে খাওয়ালাম। যাওয়ার সময় সে ভুল করে তার পার্সটা রেখে গেছে। তারপর অনেক খুঁজে তার পার্স ফেরত দিয়েছি। বললাম, আমি তোমার মতোই একজন ছাত্র। টাকা সে নিতে চায়নি। সেসময় আমি শুধু সময় কাটাচ্ছি কবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব। আরেকদিন বিকালে আমার শেফ খুব মনমরা হয়ে বলল, স্যার, আমাদের যে বিড়াল ছিল পেছনের বাগানে, সেটা মরে গেছে। আমি গিয়ে দেখলাম সত্যিই নড়ে না চড়ে না। খেয়ে দেয়ে বেশ তরতাজা হয়েছে। বিলেতি বিড়াল আর কি। রাত এগারোটার সময় যখন আমি খাবার দিচ্ছি আমার কাস্টোমারদের, সে তখন দৌড়ে এসে বলল, স্যার! বিড়াল! ইটস লাইফ। তারমানে বিড়াল, ইটস অ্যালাইভ! এ রকম অনেক মজার ঘটনা আছে বিদেশ বিভূঁইয়ের।
মোস্তফা কামাল: আপনার এই যে দীর্ঘ শিক্ষকজীবন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কি আমাদের শিক্ষাবিমুখ করে? চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে না। আপনার কী মনে হয়?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ পেরুল। আমার শিক্ষকতার বয়স বায়ান্ন পেরুল। আমি এখনও খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি। শিক্ষার সমস্যাটি হচ্ছে আমাদের তো পথ বাতলে দিয়েছিল কুদরত-ই-খুদা-কমিশন। বঙ্গবন্ধু সময় পাননি কুদরত-ই-খুদাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে। তারপর থেকে তো সামরিক শাসন। আর এখন তো হ-য-ব-র-ল অবস্থা। আপনি যেটি বলছেন, তার সঙ্গে আমি একমত। শিক্ষকতা কিন্তু চাকরি নয়। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ১৭ ধারায় বলা আছে, একমুখি শিক্ষা। যেটি কুদরত-ই- খুদা-কমিশনে স্পষ্ট করে বলা আছে। কিন্তু আমরা তো দেখি বহুমুখী শিক্ষা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। আমিতো দেখি এডভোকেট মঞ্জুর মোরশেদ জনগুরুত্বপুর্ণ অনেক বিষয় রিট করলেও এটি কেন করেন নি জানা নেই। রিট করলে সরকার কিন্তু আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যাবে। কারণ পরিপুর্ণভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করছে। শিক্ষার সর্ব সাম্প্রতিক যে অবস্থা, উপচার্য কেন্দ্রিক বিতর্ক চলছে। সেখানে বলা হচ্ছে অনুপযুক্ত অযোগ্য ব্যক্তিদেরকে উপাচার্য বানানোর ফলে অধিকাংশ ক্যাম্পাস অশান্ত হয়ে উঠেছে। আমাদের ৬ জন উপাচার্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এটি কিন্তু সরকারের জন্য ভালো হচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে চলবে বঙ্গবন্ধু কিন্তু সেটি দেখিয়ে গেছেন। কবির চৌধুরী যখন শিক্ষাসচিব হলেন, তখন একদল আমলা গিয়ে বলল, আমরা কোথায় যাব? বঙ্গবন্ধু বললেন, শিক্ষিত মানুষকে শিক্ষার দায়িত্ব দিয়েছি। তোমরা কেরানি, কেরানিই থাকো।
মোস্তফা কামাল: বঙ্গবন্ধু কন্যা বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করছেন কি না।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: আমি তা মনে করি না।
মোস্তফা কামাল: শাহজালাল ইউনিভার্সিটিতে এখন যে চলমান সংকট এটি নিয়ে কি বলবেন? এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনীতি না হওয়াই ভালো। তখন সৎ যোগ্য দক্ষ ব্যক্তিদের উপাচার্য বানিয়েছেন। এখনকার বিবেচনায় অযোগ্য অসৎ অদক্ষ ব্যক্তিদের উপাচার্য বানাচ্ছে। বেরিয়ে আসার একটি পথ হলো, যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। যোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। একটি বিষয় আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন, যেসব উপাচার্য নিয়ে সমস্যা, তাদের প্রত্যেকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
মোস্তফা কামাল: শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী এ নিয়েও নানাবিধ সমালোচনা হচ্ছে। কি বলবেন?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: দলবদলের রাজনীতি আগেও ছিল, এখনো আছে; কিন্তু কথা হচ্ছে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ঠিকঠাক মতো আছে কি না। সরকার তাকে কেন উপাচার্য বানাল? আমার এটি প্রশ্ন। এজন্যই যোগ্য মানুষকে ঠিক জায়গায় বসান। সব ঠিক হয়ে যাবে।
মোস্তফা কামাল: আপনি তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের দেশে সরকারি অর্থাৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগেও নানা অনিয়ম দেখা যায়।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: এগুলোতে নিয়ম নীতিমালা থাকা দরকার। উপাচার্য নিয়োগের কোনো নীতিমালা নেই।
(চলবে)
এসএ/