ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
হাতুড়ি-বাটাল-ছুরি-চাকু-প্লায়ার্স দিয়ে করা হয় ময়নাতদন্ত
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ কাটা-ছেঁড়া করা হয় আদিকালের হাতুড়ি-বাটাল আর ছুরি-চাকু, প্লায়ার্স দিয়ে। মেডিকেল কলেজের অধীন মর্গটিতে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এ পদ্ধতিতেই কাজ চলছে। সনাতনী এই কায়দায় একটি মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে। অনেক ক্ষেত্রে এই সনাতন পদ্ধতিতে ময়নাতদন্তের পর প্রতিবেদনের মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
মর্গ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ডিজিটাল যুগে সেকেলে কায়দায় হাতুরি-বাটাল-ছুরি দিয়ে চলছে মৃতদেহ কাটা-ছেঁড়ার কাজ। আমাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকা অনেক দেশে মরদেহের শরীরে থাকা কোনো বস্তুকে শনাক্ত করতে ডিজিটাল পোর্টেবল এক্সরে মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে দুই মিনিটেই শনাক্ত করা যায় মরদহের ভেতরে থাকা বুলেটের অগ্রভাগ (প্রোজেক্টাইল), ছড়রা গুলির প্যালেট, বোমা বা এ জাতীয় বস্তুর স্প্লিন্টার ইত্যাদি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো মেডিকেল কলেজ বা হাসপাতালে এ ধরনের মেশিন (ডিজিটাল পোর্টেবল এক্সরে মেশিন) নেই। অর্থাৎ গুলিবিদ্ধ, বোমা বিস্ফারণ, ছুরিকাঘাতসহ বিভিন্ন আঘাতজনিত ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহটিকে অনিবার্যভাবে শিকার হতে হয় বেহিসাব কাটা-ছেঁড়ার। পাশের দেশ ভারত-নেপাল-শ্রীলংকাসহ আরও অনেক দেশে ফরেনসিক বিভাগ এই মেশিন ছাড়া ময়নাতদন্তের কথা চিন্তাও করতে পারে না।
ঢামেক হাসপাতালের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৫৯৮ জনের ময়নাতদন্ত হয়। এর মধ্যে অজ্ঞাত পরিচয়ের মরদেহ ছিলো ৯৫টি। বছর শেষে এই মরদেহগুলো আঞ্জুমান মফিজুল মাধ্যমে দাফন করা হয়।
রুটিন অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে কাটা-ছেঁড়ার মাধ্যমে একটা ডেডবডির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। অথচ ডিজিটাল পোর্টেবল এক্সরে মেশিনমেশিনটির দামও আহামরি কিছু নয়, পাঁচ-সাত লাখ টাকা মাত্র। কিন্তু এই একটি মেশিনের অভাবেই ঢাকা মেডিকেল মর্গে পুরোনো কায়দায় ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হচ্ছে। এতে অন্য লাশগুলোকে অপেক্ষমান রাখতে হচ্ছে দীর্ঘ সময়। ফলে প্রায়ই পঁচন ধরে সেইসব মরদেহে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢামেকের মর্গে ৫টি ফ্রিজ আছে। এর মধ্যে ২টি নষ্ট। ১টি এই চলে তো এই চলে না অবস্থায়। বাকি সচল ২টির মধ্যে ১টিতে মাসের পর মাস জঙ্গি ও বিদেশিদের মরদেহ থাকে। বাকিটিতে ৮-৯টি মরদেহ রাখা যাচ্ছে। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পাঁচটার মধ্যে ৮-৯টি লাশের ময়নাতদন্ত করা হয় এখানে। যেদিন গুলিবিদ্ধ লাশ আসে, সে দিন পুরো সময় ওই লাশ কাটতে পার হয়ে যায়। ফলে অন্য লাশগুলো ফ্রিজে রাখার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু ফ্রিজ তো মাত্র দুটি! তাই ফ্রিজে জায়গা না হওয়ায় লাশগুলোকে বাধ্য হয়ে মেঝেতে ফেলে রাখতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিগত কারণে মরদেহ সংশ্লিষ্ট আলামতও নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। লাশের পচন প্রক্রিয়ার কারণে অনেক সহজলভ্য, সুস্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য আলামতও নষ্ট হচ্ছে প্রতিদিন।
ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাকসুদুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষকে অনেক বার মৌখিক ও লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে, যে এখন ডিজিটাল যুগে আদিকালে যন্রপাতি দিয়ে ময়না তদন্ত করা খুবই কষ্ট কর হয়ে পড়েছে। তাই আধুনিক যন্ত্রপাতি আনার জন্য বলা হয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলে তাতে কাজ করার অনেক সুবিধা হবে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মর্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক সঠিকভাবে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করতে পারছেন না। ফরেনসিক বিভাগ নিশ্চিত হতে পারছে না ঘটনার সঠিক কারণ বিষয়ে এবং একইভাবে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক পুলিশ কর্মকর্তাও পালন করতে পারছেন না দায়িত্বের পুরোটুকু। ফলশ্রুতিতে ভুক্তভোগী জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়েও প্রশ্নের পর প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।
ঢামেক হাসপাতালের মর্গ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত অজ্ঞাতপরিচয় ৭ টি মরদেহ এই হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে। যার মধ্যে রয়েছে খিলক্ষেতের দুটি, শাহবাগের দুটি ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের একটিও কমলাপুরে দুটি । এর মধ্যে খিলক্ষেতের দুটিই অজ্ঞাত মরদেহ ছিল। মরদেহটি থেকে ২৫টি প্যালেট উদ্ধার করেছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। শাহবাগ থেকে উদ্ধার রাকিবের মরদেহ দেহ থেকে ১৪টি ট্যালেট পায় ফরেনসিক বিভাগ।
ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো.বাচ্চু মিয়া বলেন, মর্গ আধুনিক না হলে, কম-বেশি ভুল থেকেই যাবে। মর্গে কাটা ছেঁড়ার আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকতে হবে। পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডোম থাকতে হবে। একইসঙ্গে কাজের প্রতি মনোযোগ থাকা দরকার সংশ্লিষ্টদের।
একদিকে লোকবলের তুলনায় অত্যধিক মরদেহ, অন্যদিকে মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি এবং দরকারি অনেক অনুষঙ্গের অনুপস্থিতি- এসব বহুমুখী জটিলতার কারণে অনেক সময় সঠিকভাবে ময়নাতদন্ত সম্ভব হয় না। ফলে অনেক প্রতিবেদনেই ভুল রিপোর্ট আসে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফরেনসিক কর্মীরা জানান। সেই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট মামলাও ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে- এমনটা দাবি করছেন পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি ঢামেক হাসপাতালের মর্গ ঘুরে দেখা গেছে পুরানো যন্ত্রপাতি ও জরাজীর্ণ আসবাবপত্র। যেন সাইনবোর্ড হয়ে সেসবই প্রকাশ করছে মর্গটির মুমূর্ষু অবস্থার কথা।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বিশেষজ্ঞ ও উপযুক্ত যন্ত্রপাতি সংকটের কারণে দেশজুড়ে আলোচিত অনেক হত্যাকাণ্ডের পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট নিয়ে জনমনে সন্দেহ, উদ্বেগ ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এমনকি অনেক নির্মম হত্যাকাণ্ডের ময়নাতদন্তে পাওয়া ভুল প্রতিবেদনের কারণে তা আত্মহত্যা হিসেবে মেনে নিতে হয় পুলিশ, আদালত ও স্বজনদের। কখনো কখনো মর্গের অবস্থা এর চেয়েও নাজুক অবস্থায় পৌঁছায়। অনেক ক্ষেত্রেই পুরোপুরি মর্গসহকারী বা ডোমের ওপর নির্ভরশীল দেশের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালটির ময়নাতদন্ত বিভাগ। ময়নাতদন্তকে গুরুত্ব না দেওয়ায় ফরেনসিক প্রতিবেদন ভুল আসছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মোহাম্মদ টিটু মিয়া ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের মর্গে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে। তবে সেই তুলনায় আধুনিক করতে পারিনি। আমাদের যা যা লাগবে আমরা ফরেনসিক বিভাগ দিয়ে সেটার তালিকা করে ফেলেছি। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথাও হয়েছে। খুব শিগগিরই আমরা এর ব্যবস্থা করে ফেলবো।
এএইচ/