বিশেষ সাক্ষাৎকার : শেষ পর্ব
রাষ্ট্রপতির সংলাপকে ইতিবাচকভাবে দেখি: নুর
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে হুংকার দিয়ে লাইম লাইটে আসা ছাত্রনেতা থেকে জাতীয় নেতা হয়ে উঠা নুরুল হক নুরের লক্ষ্য এবার ছাত্রলীগ-যুবলীগ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী এই সংগঠন দুটির কর্মকাণ্ডের ব্যাপক সমালোচনা করেন তিনি। সারা দেশে ছাত্রলীগ যুবলীগের কোন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড চোখে পড়লেই তাদের নেতা-কর্মীরা সেগুলোর ভিডিও অথবা স্থিরচিত্র সংগ্রহ করছেন বলেও জানান তিনি। সেইসঙ্গে নির্বাচন ও দলীয় নবন্ধন প্রশ্নেও ঢাকাপ্রকাশের সঙ্গে আলাপচারিতায় নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনারা যে নতুন দল গঠন করেছেন গণ অধিকার পরিষদ, ঢাকার বাইরে গণ অধিকার পরিষদ কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
নুরুল হক নুর: একটা রেসপন্স আছে; কিন্তু আমরা সেটা দেখাতে পারছি না। কারণ আমরা ঢাকার বাইরে গেলেই আমাদের উপর হামলা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুন্ডাপান্ডা হামলা করছে। আমাদের দল ঘোষণার পর ১৭ নভেম্বর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মাজারে গিয়েছিলাম সেখানে আমাদের উপর হামরা করেছিল। এই হামলা-মামলার পরও চেষ্টা করছি ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার। একটা জায়গায় আমরা আশাবাদী। যেহেতু বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনে বর্তমান পুলিশ প্রধান, র্যাব প্রধানসহ অনেকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, কাজেই আমরা যদি এই হামলা মামলার তথ্য প্রমাণগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে পারি তাহলে তো ছাত্রলীগ-যুবলীগকেও নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিক মহল ঘোষণা করবে। আমরা সেই তথ্য সংগ্রহের কাজ করছি এবং আমরা মানবাধিকার সংগঠনসহ সবাইকে বলব যারা এই ধরণের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে, তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে নিষেধাজ্ঞা আনয়নের জন্য সকলের কাজ করা উচিত। এ ধরণের সহিংস কর্মকাণ্ডকে কারও সমর্থন দেওয়া উচিত না।
ঢাকাপ্রকাশ: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে যদি আপনার নিকট জোট গঠনের প্রস্তাব আসে তাহলে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
নুরুল হক নুর: আমরা ক্ষমতায় যেতে বা ভোটের মাঠে জোট করতে আগ্রহী না। এটা আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত। আমাদের সিদ্ধান্ত–আমাদের রাজনীতির স্বতন্ত্রতা তুলে ধরতে হবে। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দল আছে। যখন ১৪ দলের ছোটখাটো দল বলে তখন মানুষ যদি ছোটখাটো দলে থাকে, তার মধ্যে একটা বিষয় কাজ করে–আমি এই ছোট খাটো দল না করে মূল দল আওয়ামী লীগ করব। ঠিক একইভাবে বিএনপির সঙ্গে যারা জোট করে সেই দলগুলোর ওইভাবে মাঠে খুব একটা অবস্থান নাই। তারা মনে করে লিয়াজু দল করব কেন, আমি মূল দল করব। সেই ক্ষেত্রে আমরা জোটের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত অনাগ্রহী। জোট করার ব্যাপারে নীতিগত কোন সিদ্ধান্ত নেই। তবে নির্বাচনের মাঠে জোট না করলেও দেশে গণতন্ত্র ফিরে আনার জন্য ফ্যাসিবাদের পতনের জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে আমরা জোট করতে পারি বা যুগপতভাবে, জোটগতভাবে আন্দোলন করতে পারি। এই বিষয়টাকে ইতিবাচকভাবে দেখি।
ঢাকাপ্রকাশ: কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে ভিপি নুর এখন জাতীয় নেতা। শাসন ক্ষমতায় নিজেকে মেলে ধরতে কতটুকু প্রস্তুত?
নুরুল হক নুর: সবাই তো নিজেকে আত্মবিশ্বাসী ভাবে। সবাই নিজেকে পারফেক্ট মনে করে; কিন্তু আমি নিজেকে পারফেক্টও মনে করি না, আবার নিজেকে ওভার কনফিডেন্টও মনে করি না। তবে এখন পর্যন্ত এই প্রতিকূলতার মধ্যে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেছি, বিভিন্ন রুঢ বাস্তবতাকে কাছ থেকে দেখেছি এবং সেখানে এটুকু বলতে পারি–যদি কোনো পদ-পদবীতে থাকি, তার সর্বোচ্চ সৎ ব্যবহার করব। অসৎ ব্যবহার না। আমার প্রতিজ্ঞা কিছুটা হলেও কোটাবিরোধী আন্দোলনে দেখিয়েছি। নিজে নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েও অধিকার আদায়ের জন্য আট মাস আন্দোলন করেছি এবং সেই দাবি আদায় করে ছেড়েছি। ডাকসুর ভিপি হয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হলে চাঁদাবাজি করিনি। কারও কাছ থেকে দুই পয়সা নেইনি, কোনো টেন্ডারবাজি করিনি। কোনো নিয়োগ বাণিজ্যে জড়াইনি। এ রকম একটি পদে থাকা অবস্থায় যেটা ছাত্র নেতাদের কাছ থেকে অহরহ হয়। রাজনীতিতে বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেলে সেটার সৎব্যবহার করতে পারব। মানুষের জন্য কাজ করতে পারব। সকল প্রকার অর্থ বিত্তের মোহের ঊর্ধ্বে থেকেই নিজেকে মেলে ধরতে চেষ্টা করব।
ঢাকাপ্রকাশ: গণ অধিকার পরিষদের নিবন্ধন বিষয়ে কি ভাবছেন?
নুরুল হক নুর: আমরা ভাবছি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে তাদের কাছে একটা ফরমাল আবেদন করব। এই নির্বাচন কমিশন, সরকারের দলদাস। এই নির্বাচন কমিশনের কাছে যাব না। নতুন নির্বাচন কমিশন সেরকম নাও হতে পারে। কারণ বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে এখন এই সরকারের পতনের ঘণ্টা ধ্বনি বাজছে। আগামীতে তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। সুতরাং যারা প্রশাসনে আছেন, নির্বাচন কমিশনে থাকবেন, তাদের মধ্যে এরইমধ্যে একটা মিথস্ক্রিয়া লক্ষ্য করতে পারছি। সে কারণেই আমরা নির্বাচন কমিশনের যে শর্ত–২২টা জেলা কমিটি করা, ১০০ উপজেলা কমিটি করা–আমরা এসব প্রস্তুত করে নতুন নির্বাচন কমিশনের কাছে নিবন্ধনের জন্য আবেদন দেব। নিবন্ধন পেলে ভালো, না পেলে গণতান্ত্রিক দাবি আদায়ের জন্য যেসব শান্তিপূর্ণ পথ আছে, সেই আন্দোলন সংগ্রাম বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা আমরা সেইভাবে করব।
ঢাকাপ্রকাশ: নিবন্ধন না পেলে কিভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন?
নুরুল হক নুর: মই দিয়ে কাউকে গাছে উঠিয়েছেন। মইটা সরালে সে আর নামতে পারবে না। সরকারকে কিছু সুবিধাভোগী মানুষ তাদের বিনা-ভোটে তাদের ক্ষমতায় রেখেছে, তারা সরে যাচ্ছে। এখন সরে যাওয়ার নিরাপদ রাস্তা পাচ্ছে না। তার জন্য তারা রাস্তাও খুঁজছে। আমি বিশ্বাস করি, এ ক্ষেত্রে তারা আর কোনো রাজনৈতিক জটিলতায় যাবে না। সে ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সকল শর্ত মেনে নেবে এবং সবাইকে নিবন্ধনসহ যে ধরনের জটিলতা রয়েছে সেগুলো সমাধান করবে এটা করতে হবে। বাস্তব কথা–এটা সমাধান না করে আগামীতে বাংলাদেশে নির্বাচন হবে না। আমরা হতে দেব না।
ঢাকাপ্রকাশ: রাষ্ট্রপতির সংলাপ কীভাবে দেখছেন?
নুরুল হক নুর: রাষ্ট্রপতির এ ধরণের উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখি। অন্তত যে কোনো একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে হলেও রাজনীতি দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় হয়। আপনার যে বিষয়ের উপরে আলোচনা হোক না কেন, যখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বসার সুযোগ হয়, তখন রাজনৈতিক দলগুলো দেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ পায়। দাবি জানানোর সুযোগ পায়। সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, যেসব দল আমন্ত্রণ পাচ্ছে, তাদের যাওয়া উচিত এবং রাষ্ট্রপতিরও নিবন্ধিত, অ-নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত। কারণ এখন দেশ একটা গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক দলগুলোর টিউন বুঝতে পারেন। সবার বিষয়টি বুঝে যদি নিরপেক্ষ লোকদের নিয়ে সমন্বয় একটা নির্বাচন কমিশন করেন সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্য পাবে। কিন্তু রকিব উদ্দীন এবং হুদা কমিশনের মতো যদি কলঙ্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে দলদাস ব্যক্তিদের নিয়ে কমিশন করেন, সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে কমিশন গঠন থেকেই আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে রাজনৈতিক দলগুলোর। রাষ্ট্রপতি বিষয়গুলো সর্তকতার সঙ্গেই বিষয়টির সুরাহা করবেন।
ঢাকাপ্রকাশ: দীর্ঘক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
নুরুল হক নুর: আপনাকেও ধন্যবাদ।
এসএম/এসএ/