বিশেষ সাক্ষাৎকার : পর্ব -১
অচিরেই তরুণ নেতৃত্বের উত্থান ঘটবে: নুর
কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে রাজপথে আসেন নুরুল হক নুর। সেই থেকে শুরু হয় রাজনৈতিক সংগ্রাম। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সভাপতি নির্বাচিত হন। এভাবে ধীরে ধীরে মূল রাজনীতিতে নাম লেখান ভিপি নুর। এখন বাঘা বাঘা রাজনৈতিক দলকে হুংকার দিয়ে কথা বলছেন। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তাদের নতুন দল গণ অধিকার পরিষদ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। তার বিশ্বাস অচিরেই তরুণ নেতৃত্বের উত্থান ঘটবে। রাজনীতির মাঠে নতুন এই দল কেমন করবে কি তাদের পরিকল্পনা এসব বিষয় নিয়ে ঢাকাপ্রকাশের মুখোমুখি হয়েছেন নুরুল হক নুর।
ঢাকাপ্রকাশ: দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে গণ অধিকার পরিষদের মধ্যে পার্থক্য কী?
নুরুল হক নুর: বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক দলগুলো আছে, বিশেষ করে বড় রাজনীতির দলগুলোর দিকে যদি তাকাই তাদের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা নাই। বিশেষ করে নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব রাজনীতিতে অনেক ক্ষেত্রেই আসতে পারে না। সামনে আসতে পারে না। তাদের যে একটা আকাঙ্ক্ষা থাকে জনগণের জন্য কাজ করা জনপ্রতিনিধি হয়ে যেন সুযোগ পান না। সেটা বলতে গেলে বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র নেতৃত্ব যদি দেখেন দেখবেন দুটো পরিবারের মধ্যেই তাদের নেতৃত্ব ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা বলেছিল গণ অধিকার পরিষদ গণ-মানুষের একটা সংগঠন হবে। অন্যান্য দলের থেকে এর পার্থক্য হবে কাজে কর্মে বিশেষ করে এই সংগঠনের এবং এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচনে আমরা গণতান্ত্রিক পন্থাকে গুরুত্ব দেই এবং দেব। সেটা ইতোমধ্যেই ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতৃত্ব নির্বাচন এবং যুব অধিকার পরিষদের নেতৃত্ব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেটার প্রমাণিত হয়েছে। দুটো সংগঠনেরই কমিটি রয়েছে একেবারে কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে। এমনকি গণ অধিকার পরিষদের একটি আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে আমাদের সকলের সম্মতির ভিত্তিতে আমাদের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে। আমরাও চেষ্টা করছি ছয় মাসের মধ্যে একটা কাউন্সিল করে বিশেষ করে বিভিন্ন জেলায় কমিটিগুলো দেওয়ার পর সেই কান্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে আগামীতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটা নেতৃত্ব নির্বাচন হবে। আর একটা জায়গায় পার্থক্য বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোতে মাফিয়া কর্পোরেট গোষ্ঠী থাকে যারা ডোনার সে সমস্ত দলগুলো পরিচালনার করার জন্য সেখানে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি জনগণকে আমাদের রাজনীতি দলে এবং অর্থনৈতিক ভাবেই সংযুক্ত করা। সেক্ষত্রে আমার ইতোমধ্যেই বিভিন্ন কার্যক্রমে বিশেষ করে গণ-ফাণ্ড গঠন করেছি। সেখানে আমরা দেখেছি অনেক মানুষ আমাদের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না কিন্তু আমাদেরই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছে। অর্থাৎ দলের যে অর্থনৈতিক সংস্থান সেক্ষেত্রে আমার আমাদের অভ্যন্তরীণ নেতৃবৃন্দের অনুদানের তো একটা বিষয় থাকবে পাশাপাশি আম জনতার অংশ গ্রহণের ব্যবস্থা থাকবে। এই অর্থের মধ্যে দিয়েই আমরা দলকে পরিচালনা করতে চাই যেটা অন্য দলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
ঢাকাপ্রকাশ: গণ অধিকার পরিষদ কি রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারবে?
নুরুল হক নুর: পরিবর্তনের জন্যই তো আমরা কাজ করছি। আমার বাবা কিংবা আমার পরিবারের কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি কিন্তু আমি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছি এবং ২৮ বছর পর ডাকসুর ভিপিও নির্বাচিত হয়েছি কাজেই অন্যরা পারেনি বলে যে আমরাও পারব না বিষয়টি এমন না। দেশে একটা সংকট আছে রাজনীতিতে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আস্থাহীনতার ঘাটতি আছে। সেক্ষেত্রে গণ অধিকার পরিষদ আমরা ইতোমধ্যে যে কাজগুলো করছি সেক্ষেত্রে জনগণ আমাদের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। কাজেই আমাদের এই অবস্থানটা যদি ধরে রাখতে পারি এবং এই সংকট-কালীন সময়ে আমরা যদি সামনে থেকে কাজ করতে পারি নেতৃত্ব দিতে পারি আমার বিশ্বাস আমরা আগামীতে যে পরিবর্তন সূচিতে হবে সেই পরিবর্তনের ধারক বাহক হিসেবে আমরা কাজ করতে পারব।
ঢাকাপ্রকাশ: তরুণ নেতৃত্বকে কিভাবে দেখছেন?
নুরুল হক নুর: বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই তরুণ নেতৃত্বের একটা উত্থান আছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ফিনল্যান্ডের মন্ত্রীসভা তারপর চিলিসহ বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিউ জিল্যান্ডের এই সমস্ত জায়গায় দেখা গেছে তরুণদের একটা প্রাধান্য এমনকি আমেরিকার পার্লামেন্টগুলোতেও তরুণ নেতৃত্ব বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে তার ব্যতিক্রম। বাংলাদেশে সাধারণত দাড়ি চুল পাকা ৬০ পর তারাই বাংলাদেশে এমপি মন্ত্রি হয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়। পুলিশ প্রধান অবসরের পর জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন কিংবা আর্মি থেকে অবসরে যাওয়ার পর রাজনীতিতে যাচ্ছেন। এ কারণে রাজনীতিতে তরুণদের জায়গা কমে যাচ্ছে তরুণরা জায়গা পাচ্ছে না। সেদিক থেকে আমরা তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে তারুণ্য নির্ভর একটা রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। আমি মনে করে এইরকম বাস্তবতায় তরুণরাই একমাত্র পরিবর্তন আনতে পারে। সেক্ষেত্রে তরুণদের নিয়ে আশাবাদী।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনি ভিপি থাকাকালীন বিভিন্ন সময় আক্রমণের শিকার হয়েছেন, বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন তো জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতি করছেন, আপনি জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত কি-না?
নুরুল হক নুর: যেখানে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো তথ্য দিয়েছে যে ১২ বছরের শাসনে ৬০১ জনকে গুম করা হয়েছে যাদের মধ্যে ৮৬ জন এখনও নিখোঁজ। ৩ হাজার মানুষকে বিচারবর্হিভুতভাবে হত্যা করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা। বেশি কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী র্যাবের উপরে এবং র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার উপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি দেশ নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের তো কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যে নির্যাতন নিপীড়ন গুম খুনের আশঙ্কা থাকেই। তারপরেও আমরা হতাশ নই। আমরা ভিত নই। আমরা মনে করি এই রকম অন্ধকারের ভেতরে যারা আলো জ্বালাতে চেষ্টা করবে তারাই আলোকিত করতে পারবে। আমরা চেষ্টাটি করে যাচ্ছি সেক্ষেত্রে আমাদের ভাগ্যে যা লেখা আছে তা হবে। মুসলমান হিসেবে তজদিরে বিশ্বাস করি।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনার জীবন নিয়ে শঙ্কিত বোধ করছেন কি-না?
নুরুল হক নুর: শঙ্কা বলতে একটা আশঙ্কা থাকেই যে একটা দুর্ঘটনা যে কোন সময় ঘটতে পারে। এটা তো শুধু আমার না বাংলাদেশে যারা বিরোধী যারা ভিন্ন মতের রাজনীতি করে তাদের বেশিরভাগ নেতৃত্বের ক্ষেত্রেই এই শঙ্কাটা আছেই।
ঢাকাপ্রকাশ: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পরিকল্পনা আছে কি-না?
নুরুল হক নুর: আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্যই এই রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দিয়েছি। বিশেষ করে একটা সংকট-কালীন সময়ে যেখানে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরা রাজনীতি বিমুখ হয়ে যাচ্ছে দুর্বিতায়নের কারণে। প্রশাসন এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের দমন পীড়নের কারণে অনেকে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছি যে একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার একটা সহনশীল সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তলব সে কারণেই আমরা রাজনীতিতে এই পরিবর্তনটা করতে চাই। পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে নির্বাচনে যেতে হবে। আমরা তো অবশ্যই স্বপ্ন দেখি যেটা হয়তো চেষ্টা করছি সেই পলিসি নিয়ে আগাচ্ছি। তবে আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে বর্তমান সরকারের অধীনে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আমাদের অবস্থান হচ্ছে এই সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন সুষ্ঠ হবে না এবং আমরাও সেই নির্বাচনে যাব না। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও না যাওয়ার জন্য নিরুৎসাহিত করব। আমাদের যৌক্তিক এবং ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের জন্য প্রয়োজনে আমরা আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলব। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ফিরে আনব। মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করব এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করব।
ঢাকাপ্রকাশ: তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো সংবিধানে নেই? সেটা কিভাবে ফিরে আনবে?
নুরুল হক নুর: সংবিধান তো ধর্মীয়গ্রন্থ না যে সেটা পরিবর্তন করা যাবে না। সংবিধান মানুষের জন্য এবং সময়ের প্রয়োজনে এই সংবিধানই বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয়েছে। এবং জনগণ যদি চায় অবশ্যই সংবিধান পরিবর্তন করতে সরকারকে বাধ্য হবে। সরকার যে দাম্ভিকতার সঙ্গে কথা বলছে সেটা হচ্ছে বিনা-ভোটে তাদের যে ক্ষমতা সেই ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য। এবং তারা রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন সংগ্রাম আমলে নিচ্ছে না। কিন্তু আমার মনে রাজনৈতিক দলগুলো যদি নামার মতো রাজপথে নামতে পারে এই সরকার শুধু দাবি মানবে না, জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে বিদায় নেবে সেক্ষেত্রে জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্দোলন করতে হবে রাজপথে নামতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচার শাসক ছিল কেউ স্বেচ্ছায় যায়নি। জনগণের আন্দোলনের মুখে তারা বিদায় নিয়েছে। সুতরাং যদি আন্দোলন রাস্তায় না থাকে শুধু বক্তব্য বিবৃতিতে বললে তো আর সরকার যাবে না। সরকার জনগণের দাবি এবং রাজনীতি দলগুলো দাবি মানবে না।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনি কি আওয়ামী লীগ সরকারকে স্বৈরাচার শাসক বলছেন?
নুরুল হক নুর: স্বৈরাচারি বৈশিষ্ট্যে থেকে তারা উত্তরণ করে ফ্যাসিস্ট সরকারে পরিণত হয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকার বিভিন্ন দেশে ছিল, সেসব দেশে ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের পর সেই সমস্ত দলগুলো নিষিদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগের আজকের যে অবস্থা এটা স্বৈরাচার লেবেল অতিক্রম করে ফ্যাসিস্ট সরকারে পরিণত হয়েছে। বিনা ভোটের ফ্যাসিস্ট সরকারের করুন পরিণতির পর হয়তো আওয়ামী লীগকে অন্য নাম নিয়ে রাজনীতি করতে হবে। কারণ ফ্যাসিবাদ কোথাও সমর্থন পায়নি। ফ্যাসিবাদের ধরণ হচ্ছে তারা শ্রমিকদের একটা অংশকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকে। তবে এরা (আওয়ামী লীগ) শ্রমিকদের ব্যবহার করেনি, তারা রাষ্ট্র-যন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আছে। এরা একটা ভিন্ন ধরণের ফ্যাসিস্ট সরকার। এদের পতন হবে এবং সেটা নির্মম নিষ্ঠুর পতন হবে, পতনের পর এই নাম নিয়েও রাজনীতি করবে না। নিজেদের তাগিদেই তারা পরিবর্তন করবে।
চলবে....