উজ্জীবিত তৃণমূলকে চাঙা রাখাই বিএনপির বড় চ্যালেঞ্জ
সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনসমর্থন আদায়ে সারাদেশে বিভাগীয় গণসমাবেশ করছে বিএনপি। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল ও ফরিদপুরে গণসমাবেশ শেষ করেছে দলটি। বাকি আছে সিলেট, কুমিল্লা ও রাজশাহীর বিভাগীয় গণসমাবেশ। এরপর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে বিএনপি। সেই লক্ষ্যে অনুমতি চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর আবেদন করেছে দলটি।
সম্পূর্ণ এককভাবে গণসমাবেশগুলো করছে বিএনপি, যাকে ‘কৌশলগত’ বলছেন দলটির নেতারা। বাধা সত্ত্বেও বিভাগীয় গণসমাবেশে জনস্রোত প্রমাণ করে বিএনপি এককভাবেই অনেক শক্তিশালী ও জনপ্রিয় একটি দল। প্রতিটি সমাবেশে প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি নেতা-কর্মীর সমাগম হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও বেড়েছে বলে মনে করছেন নেতারা। এমনকি গণসমাবেশের আগে যারা আন্দোলন ইস্যুতে বিএনপিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলতেন, এখন আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তারাও এগিয়ে আসতে চাইছে। যদিও আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জোটে থাকা ভোট সঙ্গী জামায়াতকে বাদ দিয়ে একক আন্দোলন রাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ কি না তা নিয়েও নানা মহলে আলোচনা চলছে। হঠাৎ করে বিদেশি কূটনীতিকদেরও যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে দেখা গেছে।
বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এখন অনেকটাই চাঙা মনোভাবে। দাবি আদায়ে বিভেদ ভুলে আত্মত্যাগের মানসিকতা নিয়ে সবাই রাজপথে নামছেন বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াকেও কর্মীদের উজ্জীবিত হওয়ার কারণ হিসেবে দেখছেন বিএনপির হাইকমান্ড। তবে শেষ পর্যন্ত এদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ধরে রাখাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন কেউ কেউ। কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, এবার দাবি আদায় ছাড়া ঘরে ফিরবে না কেউ। আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ায় উজ্জীবিত বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
তবে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, জনসমাগম বাড়লেও আগামী দিনের কর্মসূচি ও ধরন নিয়ে সতর্ক বিএনপি। আগামী নির্বাচনের এখনো প্রায় ১৩ মাসের বেশি সময় আছে। ফলে, এই মুহূর্তে বড় কর্মসূচি দিয়ে দীর্ঘ সময় টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর এ ধরনের কর্মসূচি দিলে সরকারের দমন-নিপীড়নও বাড়বে। তাই নিরপেক্ষ সরকারের দাবি, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন, সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবিতে অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে বিএনপি।
১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। এ সময়ে একাধিকবার নানা ইস্যুতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দিলেও সফল হতে পারেনি দলটি। আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতেও ব্যর্থ হয়েছেন তারা। এর নেপথ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতাকে দায়ী করে আসছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেন্দ্র ঘোষিত তৃণমূলের কর্মসূচিতে সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের জেলায় জেলায় দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। শুধু কর্মসূচি পালন নয়, তৃণমূলের কোথাও কোনো কোন্দল রয়েছে কি না- তা নিরসনেরও দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদের। প্রতিটি কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতি তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সাহস জোগাচ্ছে। যারা দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিল তারাও কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, তৃণমূলের ইউনিয়ন পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতারা। এতেও তাদের মধ্যে একটা উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। অতীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আহত ও নিহত নেতা-কর্মীদের পরিবারের পাশে সেভাবে দাঁড়ায়নি কেন্দ্র। কিন্তু এবারের চিত্র উলটো। বিগত সময় যারা নিহত ও আহত হয়েছে তাদের প্রত্যেক পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে হাইকমান্ড। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে অনেকে ঝুঁকি নিয়েই নামছেন রাজপথে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি এককভাবে বিভাগীয় গণসমাবেশের কর্মসূচি দিয়ে নিজেদের শক্তি জানান দিচ্ছে। এতে একদিকে বিদেশি শক্তিগুলো বিএনপির দিকে নজর রাখছে। পাশাপাশি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের (বিএনপি) দিকে ঝুঁকবে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, বিভেদ ভুলে আত্মত্যাগের মানসিকতা তৈরি হয়েছে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মাঝে। দীর্ঘ বিরতি ভেঙে রাজপথে ফিরেছে বলেই বিএনপির নেতা-কর্মীরা চাঙা, উজ্জীবিত। এটি হতে পারে আগামীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের রসদ। চলমান গণসমাবেশ কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের মধ্যে নতুন করে প্রাণসঞ্চার করেছে। সমাবেশে লুটপাটসহ ব্যর্থতার দায়ে এখনই ক্ষমতাসীনদের পদত্যাগের যেমন বার্তা রয়েছে, তেমনি আন্দোলন-সংগ্রামের বিষয়েও নতুন বার্তা দেওয়া হয়েছে।
নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত রাখার জন্য আপাতত সরকারবিরোধী সব দলের সঙ্গে আলোচনা করেই সরকার পতনের কর্মসূচিতে যাওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে বিএনপি। নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করার পাশাপাশি সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনসম্পৃক্ত করার উপর জোর দিচ্ছে দলটি। হামলা-মামলার শিকার ও হতাহত হওয়ার পরেও মাঠ না ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।
তৃণমূলের নেতারা বলছেন, গণসমাবেশের মধ্যে দিয়ে নতুন করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। একই সঙ্গে যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে তাও জনগণের দাবিতে পরিণত করতে পেরেছে। ফলে জনগণ এখন বিএনপির ডাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন। তবে সমাবেশের পরই বাড়ছে মামলার সংখ্যা।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ বলেন, গণসমাবেশ শুরু হওয়ার পর থেকে বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মী মাঝে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। সরকার কর্মসূচিতে নানাভাবে উসকানি ও উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আশা করি নেতা-কর্মীরা সরকারের কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেবেন না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, নেতা-কর্মীদের মধ্যে আত্মত্যাগের প্রস্তুতি চলে আসছে। সেটাতো দমানো যায় না। কোনো শক্তি সেটাকে দমাতে পারে না। এ সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে। আন্দোলন সফল না হওয়া পর্যন্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে থাকবে বলেও প্রত্যাশা করছি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, দাবি আদায়ে অবিচল থেকে তৃণমূল থেকে দলকে সুসংগঠিত করে ঐক্যবদ্ধ রাখা বিএনপির বড় চ্যালেঞ্জ। এবার তৃণমূলে শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হচ্ছে। বেশিরভাগ জায়গায় কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি দেওয়া হচ্ছে। ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৫২টিতে এরই মধ্যে কমিটি করে পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত সাবেক ছাত্রদল নেতাদের উচ্চপদে আনা হয়েছে। তৃণমূল বিএনপির বড় ভরসা। এত বাধা-সংকটের পরও তারা সফল গণসমাবেশ করছেন। তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা পায়ে হেঁটে সমাবেশে যোগ দেন। সমাবেশস্থলেই রাত কাটান। এমন বড় জমায়েত সাংগঠনিক দক্ষতার কারণেই সম্ভব হচ্ছে। তৃণমূল আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত। যেকোনো সময় কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রস্তুত আছে।
তিনি বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে উজ্জীবিত বিএনপি। চাঙা নেতা-কর্মীরা। হামলা-নির্যাতন সব বাধা উপেক্ষা করে রাজপথে বাড়ছে তাদের উপস্থিতি। গণসমাবেশ রূপ নিচ্ছে জনস্রোতে। এতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের মধ্যে বাড়ছে আস্থা ও আত্মবিশ্বাস।
বিএনপির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা বলেন, দলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যারা ব্যর্থ হচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তৃণমূল নেতা-কর্মীদেরও চাপ আছে। নেতা-কর্মীরা চান সাংগঠনিক জেলা শাখায় যেন সঠিক নেতৃত্ব দেওয়া হয়। তা না হলে নেতা-কর্মীদের কাজে গতি আসে না। এতে করে দলও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবকিছু বিবেচনা করেই নিষ্ক্রিয়দের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছেন বিএনপি হাইকমান্ড।
দুই মাসের বেশি সময় দেশব্যাপী লাগাতার কর্মসূচির পর গত ১২ অক্টোবর থেকে বিভাগীয় গণসমাবেশ করছে বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল ও সবশেষ ফরিদপুরে গণসমাবেশ করে দলটি। ওই গণসমাবেশের পর বিভিন্ন অভিযোগে বিএনপি নেতা-কর্মীদের আসামি করে মামলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ বিএনপির।
এসএন