শৌচাগার সংকটে শারীরিক ও মানসিক রোগে ভুগছে ট্রাফিক পুলিশ
রাজধানী ঢাকার সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছেন ট্রাফিক পুলিশের ৫ হাজারেরও বেশি সদস্য। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-বাদলে সমানতালে কাজ করেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। দিনে-রাতে পরিশ্রম করলেও রাস্তায় কাজ করা এই সদস্যেদের সমস্যার শেষ নেই। বিশেষ করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে পড়েন সবচেয়ে বড় সংকটে।
নগরীর সিংহভাগ এলাকায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের জন্য নেই শৌচাগার সুবিধা। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে বা ক্লান্তি আসলে একটু বিশ্রামেরও সুবিধা নেই কোথাও।
এ নিয়ে ট্রাফিক পুলেশর সদস্যদের মধ্যে যেমন ক্ষোভ আছে, তেমনি চিকিৎসকরা বলছেন, দিনে-রাতে পরিশ্রম করা পুলিশের এই সদস্যরা শুধুমাত্র শৌচাগার সংকটের কারণে মূত্রনালির সংক্রমণ, পেটের ব্যথা, জ্বর, জ্বালা-যন্ত্রণাসহ নানান রোগে ভোগেন। শারীরক ও মানসিকভাবেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
নগরীর বিভিন্ন সড়ক মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা জানান, তাদেরকে হয় গণ-শৌচাগারে কিংবা রাস্তার আশেপাশের ভবনগুলোতে যেতে হয়। এ কারণে প্রায়ই অস্বস্তিতে পড়তে হয়। তাদের দাবি, অবিলম্বে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা হোক।
ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ২৫০ টিরও বেশি ট্রাফিক পুলিশ বক্স রয়েছে। কিন্তু ট্রাফিক বক্স থাকলেও তাদের ট্রাফিক সদস্যদের জন্য কোথাও শৌচাগার সুবিধা নেই। অব্যশ্য ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীতে উন্নত মানের কোনো ট্রাফিক বক্স নেই। উন্নত বক্স হলে এবং আশেপাশে একটু জায়গা থাকলে এ সমস্যার সমাধান কিছুটা হলেও সম্ভব হবে।
ট্রাফিক পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, দুই সিটি করপোরেশনের কারণে বন্ধ হয়ে আছে ট্রাফিকের জন্য শৌচাগার নির্মাণের কাজ। রাজধানীতে যে সকল ট্রাফিক বক্স আছে সেগুলো অধিকাংশ সিটি করপোরেশনের জায়গার মধ্যে পড়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ট্রাফিক পুলিশ বক্স ঘুরে দেখা গেছে, সব জায়গায় শৌচাগারের সংকট। পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা বিশ্রামও নিতে পারেন না। রাস্তার পাশে বা গাছের আড়ালে বসে বিশ্রাম নিতে হয় তাদেরকে। ট্রাফিক পুলিশের কোনো সদস্য তাৎক্ষণিক অসুস্থ হলে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে একটু শুয়ে থাকার কোনো পরিবেশ বা ব্যবস্থা নেই।
গুলশান জোনের ট্রাফিক সার্জেন্ট সাদ্দাম বলেন, ট্রাফিকদের নানান সমস্যার মধ্যে বড় সমস্যা হল কর্মস্থলের পাশে টয়লেট না থাকা। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া উচিত।
কারওয়ান বাজারে কথা হয় ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মো. মঞ্জুরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, শৌচাগার ব্যবহারের জন্য আমাদেরকে বাইরের মার্কেট বা অফিসে যেতে হয়। যা লজ্জাকর ব্যাপার। এটির জরুরি সমাধান হওয়া উচিত।
রাজধানীতে কর্মরত ট্রাফিক সার্জেন্ট মোছা. কাজল রেখা ও সাবিনা খাতুন বলেন, শৌচাগার সমস্যার কারণে তাদেরকে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে পড়তে হয়। এটি একটি বড় সমস্যা। প্রথম প্রথম খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। পরবর্তীকালে কর্তব্য এলাকার কাছাকাছি সরকারি বা বেসরকারি অফিসে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হয়। এই সমস্যাটি সমাধান হওয়া জরুরি। এটা মানবিক বিষয়।
প্রায় একই কথা বলেছেন পলাশী মোড়ে কথা হওয়া ট্রাফিক পুলিশের সার্জেট মো. সিরাজ, ঢাকা মেডিকেল ও দোয়েল চত্বর এলাকায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট খায়রুল আলম।
তারা বলেন, মাঝে মাঝে হঠাৎ করে আমার পেট ব্যথা শুরু হলে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। শৌচাগার সমস্যার সমাধান হওয়া জরুরি। কারণ, পুলিশের পোশাক পরে নারী বা পুরুষ ট্রাফিকের সদস্যরা যদি বাইরে টয়লেট করতে যায় তাহলে বিভিন্ন ধরনের আজেবাজে মন্তব্যের মধ্যে পড়তে হয়। বিশেষ করে নারী সদস্যদের।
অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের নীতি নির্ধারকেরা বলছেন, শৌচাগারের সংকটটি দীর্ঘদিনের হলেও কিছু কিছু জায়গায় সমাধান করা হয়েছে। অনেক জায়গায় এটি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না।
তারা বলেন, অধিকাংশ ট্রাফিক পুলিশ বক্স সিটি করপোরেশনের অধীনে হওয়ার কারণে তারা জায়গা দিতে চায় না। ট্রাফিক বিভাগ রাস্তার পাশে শৌচাগার তৈরি করলে বা একটু বেশি জায়গা নিয়ে পুলিশ বক্স তৈরি করলে সিটি করপোরেশন সেটা ভেঙে দেয়।
ঢাকা মহানগর ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম বলেন, নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নয়নে নারী এবং পুরুষ ট্রাফিক সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সরকারের সহযোগিতায় এসব সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে। কিন্ত এই সমস্যা এখনো সমাধান হয়নি।
কারওয়ান বাজার মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আনোয়ার কবির হোসেন বলেন, এখানে ৩৩ জন পুলিশ সদস্য প্রতিদিন ডিউটি করেন। তারা প্রকৃতির ডাকে বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। প্রচণ্ড গরমে ট্রাফিক বক্সে বসা যায় না। শৌচাগার নাই,হাত মুখ ধোয়া যায় না। নানা ধরনের সমস্যা মাথায় নিয়েই ট্রাফিকের সদস্যরা কাজ করেন।
মোহাম্মদপুর জোন ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. কায়েস বলেন, রাজধানীর কোথাও মানসম্মত তেমন কোনো ট্রাফিক বক্স নাই। মানসম্মত ট্রাফিক বক্স দরকার, যাতে পুলিশ সদস্যরা সেখানে খাবার খেতে পারেন বা খারাপ লাগলে একটু বিশ্রাম নিতে পারেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. আনোয়ার কবির ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কোনো মানুষ যদি মলমূত্র চেপে ধরে রাখে তাহলে শারীরিকভাবে নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। যেমনতিনি খুব কম সময়ের মধ্যে পাইলস বা পেটের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক ভাবে অসুস্থ হতে পারেন।
জানতে চাইলে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক গৌরব রঞ্জন সরকার বলেন, অনেক সময় ধরে টয়লেট বা প্রসাব ধরে রাখলে ইউরিন ইনফেকশন হয়। এ কারণে জ্বর, ব্যাথা, জ্বালা-যন্ত্রণাসহ অন্যান্য রোগ দেখা দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ট্রাফিক পুলিশের দীর্ঘদিনের দাবি টয়লেট বা শৌচাগারের দাবি যৌক্তিক। এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করা দরকার।
ট্রাফিক পুলিশের প্রধান কমিশনার মনিবুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কিছু কিছু জায়গায় শৌচাগারের সংকট সমাধান হয়েছে। সিটি করপোরেশন আমাদের বলছে অনেক জায়গায় শৌচাগার তৈরি করতে অসুবিধা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই সংকটটি সমাধানের জন্য আলোচনা চলছে এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আশাকরি এটি সমাধান হবে।
এনএইচবি/এমএমএ/