তৃণমূলের অংশগ্রহণ দেখে উজ্জীবিত কেন্দ্র
আন্দোলনে কৌশল পরিবর্তন ভাবনায় বিএনপি
বিএনপির সমাবেশ
খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের সমাবেশ কর্মসূচিতে তৃণমূল-পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ দেখে উজ্জীবিত বিএনপি নেতারা। কোনো কোনো সমাবেশের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যেভাবে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছে তাতে দলের নেতারা আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ ধারণা পাওয়া গেছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে সুচিকিৎসার দাবিতে সারাদেশের বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ২২ ডিসেম্বর থেকে ৩২টি স্থানে সমাবেশ করার কর্মসূচি শুরু হয়। কিন্তু ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩০টি স্থানে কর্মসূচি পালন করে দলটি। স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় নওগাঁ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সমাবেশ স্থগিত রাখা হয়েছে। ২০টি জেলায় কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে। সিরাজগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, ফেনী, ঝিনাইদহ, পটুয়াখালী ক্ষমতাসীন দল ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত সমাবেশ করেছে নেতা-কর্মীরা। হবিগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারির কারণে সমাবেশ হতে পারেনি। যশোর, ফেনী, কক্সবাজারে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে সমাবেশ করা হয়েছে। এর বাইরে গাজীপুর, সিলেট ও টাঙ্গাইলে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
এসব সমাবেশে কেন্দ্রীয় নেতারা যোগ দেন। বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। বিপুল এই অংশগ্রহণ বিগত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি আর এ রকম কর্মসূচি করতে পারেনি।
২ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে দাবি আদায়ের যে প্রক্রিয়া আমরা শুরু করেছি এতে ভীত হয়ে আওয়ামী লীগ এবং এই অনির্বাচিত সরকার গণতান্ত্রিক শক্তির উপরে আক্রমণের পর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে, হামলা করছে, গুলিবর্ষণ করছে, গায়েবি মামলা দিচ্ছে।’
তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ ও লড়াকু মনোভাব দেখে উজ্জীবিত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগ) রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘নির্যাতন নিপীড়নের মুখে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দলীয় কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, তারা এই সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তারা খালেদা জিয়ার বিদেশে সুচিকিৎসা ও সরকার পতনে জোরালো আন্দোলনে যেতে চায়।’
যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘হামলা-মামলা, গুম, খুন, গ্রেপ্তার নির্যাতন উপেক্ষা করে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সমাবেশে যোগ দিয়ে আবারও প্রমাণ করেছে তারা দল, দলের নেতৃত্ব ও দলীয় কর্মসূচির প্রতি কতটা কমিটেড। ক্ষমতাসীন সরকার ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী সমাবেশকে কেন্দ্র করে মনপুরা থেকে ভোলাকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কিন্তু নেতা-কর্মীরা এতটাই উজ্জীবিত ছিল যে, তারা থাকা-খাওয়ার অনিশ্চিয়তা ভুলে গিয়ে সমাবেশে যোগ দিতে এক-দুই দিন পূর্বেই ভোলায় চলে আসেন।’
তিনি বলেন, ‘তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সব সময় অগ্রগামী। চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে তাদের রাজনীতি। তাদের ত্যাগের কোনো কিছুর বিনিময় হবে না। বরং তারা নিজ ঘরে নিজ দেশে পরাধীনতায় বাঁচতে চায় না। চায় সরকার পতনে এক দফা আন্দোলন। তারা বিশ্বাস করে শেখ হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার মুক্তি আসবে না, গণতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না।’
বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগ) ওবায়দুর রহমান চন্দন ঢাকাপ্রকাশকে জানান, ‘প্রয়োজনে জীবন বাজি রেখে দলীয় কর্মসূচিতে জয়পুরহাটে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতায় অভিভূত। সরকারের দমন-পীড়ন তারপরও তৃণমূল নেতা-কর্মীরা যে এত দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে তা কিছুটা অপ্রত্যাশিত ছিল।’
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা তৃণমূলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা সবাই চাই ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন। সেই লক্ষ্যে আন্দোলন কখন কোন দিকে যায় সেটা সময় বলে দিবে।’
জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘শত বাধা অতিক্রম করে নরসিংদীতে সমাবেশ সফল করেছি। শুধু তৃণমূল নয় দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ। সরকার পতন ও খালেদা জিয়ার বিদেশে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে আন্দোলনের বিকল্প কোনো ভাবনা তৃণমূল নেতা-কর্মীদের নেই। তাদের চোখে মুখে সরকারবিরোধী প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। যেকোনো মূল্যে সরকারের পতন ত্বরান্বিত করতে ঐক্যবদ্ধ। শুধু তাই নয় তারেক রহমানের নেতৃত্বে আগামী দিনে যে কোনো দিক নির্দেশনা পালনে জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত তৃণমূল নেতা-কর্মীরা।’
পটুয়াখালী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ বাহাউদ্দিন বাহার ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘ক্ষমতাসীন সরকারের আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর (পুলিশ) নির্যাতন সহ্য করে তৃণমূল কোনো রকমে বেঁচে আছে। আগে একটু ভীত থাকত, কর্মসূচিতে খুব একটা বের হতো না। তবে এখন সেই ভয় নেই। তারা এখন বাঁচার মতো বাঁচতে চায়, দেশের জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার কারামুক্তি, বিদেশে পাঠিয়ে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে অনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সরকার পতনের আন্দোলন চায়।’
তৃণমূলের সমাবেশের সাফল্য দেখে দলের নেতাদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে এত দিনের ‘ধীরে চলা নীতি’ থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে চলমান সমাবেশ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সাংগঠনিক পুনর্গঠনের দিকেও নজর দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য দলের পুনর্গঠন কাজের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে বিশেষ বার্তা পাঠানো হচ্ছে। পুনর্গঠন কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। নেতাদের লক্ষ্য, চলমান আন্দোলনকে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের দিকে নিয়ে যাওয়া।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে কর্মসূচিতে আমরা জনমত আদায়ে চেষ্টা করছি। অনেক ক্ষেত্রে সফল হচ্ছি। ফলে এখন শুধু বিএনপি নয় দেশের অর্ধেকের বেশি জনগণ চায় খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা হোক। আমরা দাবি আদায়ে আন্দোলনে আছি এবং দাবি আদায়ে রাজপথই ফয়সালা করবে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও ধরণ।’
পরবর্তী আন্দোলন-কৌশল কী হতে পারে, এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘আমরা জেলাগুলোতে সমাবেশ করছি। ইতিমধ্যে প্রায় অর্ধেক জেলায় সমাবেশ শেষ হয়েছে। আরও অর্ধেক জেলায় সমাবেশের পরিকল্পনা কর্মসূচি রয়েছে। জেলা পর্যায়ের সমাবেশ শেষ হলে দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরবর্তী কর্মসূচি ও আন্দোলনের ধরণ কৌশল চূড়ান্ত করা হবে।’
এপি/টিটি