স্থানীয় উৎসের গ্যাস অনুসন্ধানে অবহেলা, সংকটে দেশ
গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। একদিকে গ্যাসের মজুদ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে অন্যদিকে জ্বালানি আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় পুরো জ্বালানি আমদানিনির্ভর একটি দেশে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বরাবরই নতুন গ্যাসকূপ অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। একারণেই মূলত আজকের এ সংকট।
ভূতত্ত্ববিদরা মনে করছেন বাংলাদেশে প্রচুর গ্যাস রয়েছে। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে মাথায় নিয়ে কখনোই তেমনি অনুসন্ধানকাজ চালানো হয়নি। বারবার বলা হয়েছে বাপেক্সকে শক্তিশালী করার কথা। কিন্তু কার্যত তেমন কিছুই হয়নি।
অনুসন্ধানে অবহেলা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে এবং অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় বাংলাদেশ তার মজুদ খুঁজে বের করতে এবং ট্যাপ করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। শুধু তাই নয় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের তুলনায়ও বাংলাদেশ অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে কম। ত্রিপুরার মতো ছোট্ট একটি রাজ্য যেখানে ১৫০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে সেখানে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে প্রায় ১০০টি ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে কম অনুসন্ধানকারী দেশের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মাত্র এক তৃতীয়াংশ গ্যাস অনুসন্ধান করা হয়েছে। গ্যাস আবিষ্কারের সাফল্য যদিও এখানে বৈশ্বিক গড় থেকে অনেক বেশি, তারপরও এখানে অনুসন্ধান কমই হয়েছে।
এ ছাড়া, গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রা সীমা রয়েছে যেটা ২৬টি ব্লকে বিভক্ত। এর মধ্যে ২৩টিই এখনো উন্মুক্ত। মাত্র তিনটি ব্লকে ভারত ও সিঙ্গাপুরের তেল কোম্পানি অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
অথচ ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধ মিটে যাওয়ার পর দুটি দেশই তাদের সমুদ্রসীমা দ্রুত অনসন্ধান চালিয়ে গ্যাস আবিষ্কারও করেছে। ইতিমধ্যে মিয়ানমার তার আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে। ভারত ২০২৩ সাল থেকে উত্তোলন শুরু করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সঙ্কটকে রাশিয়াা-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে দাবি করা হলেও তা আংশিক সত্য। মাটির নিচ থেকে গ্যাস উত্তোলনে কাজ না করা এই সঙ্কটের অন্যতম কারণ।
আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি খাতের পরিকল্পনাতেই গলদ রয়েছে। পরিকল্পনায় উৎপাদনের চেয়ে আমদানিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের মহাপরিকল্পনা ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান-২০১৬’ দেখলেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়। সেখানে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যে জ্বালানি লাগবে তার ৪০ ভাগই আমদানি করতে হবে। এটা ২০৪০ সালের মধ্যে হবে ৯০ ভাগ।
পেট্রোবাংলা বলছে, ২০২৩ সালের মধ্যে গ্যাসের উৎপাদন কমে যাবে। তাই আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি আমদানির উপর গুরুত্ব দিলেও অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেয়নি।
বছরের পর বছর শুধু উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এগুলো কীভাবে চলবে, জ্বালানির সংস্থান কীভাবে করতে হবে সেগুলো নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। যেকারণে আজ দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানির অভাবে পড়ে আছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এখন জরুরি ভিত্তিতে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে জোর দিতে হবে। অনেক আগেই এমনটা করা উচিত ছিল। তাহলে আজ এত খারাপ অবস্থা হতো না।
অবশেষে অনুসন্ধানে মনোযোগ
পরিস্থিতি জটিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে সরকার নিজস্ব অনুসন্ধানে মনোযোগ বাড়িয়েছে। সম্প্রতি ৪৬টি কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ বলছে, এখান থেকে জাতীয় গ্রিডে ভাল পরিমাণে গ্যাস যুক্ত করা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এক বিবৃতিতে জানান, নিজস্ব জ্বালানির অনুসন্ধান, উৎপাদন বৃদ্ধি ও কূপগুলোর আরও গভীরে খনন করার জন্য গ্যাসের অনুসন্ধান কাজ চালাচ্ছে সরকার। আগামী তিন বছরের জন্য একটা আপগ্রেডেশন, ওয়ার্ক অর্ডারের স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ৪৬টি কূপ থেকে দৈনিক ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
আরইউ/এমএমএ/