লাইসেন্সহীন চালকের হাতে আব্দুল্লাহপুর-টঙ্গীর মানুষের প্রাণ!
আশুলিয়া থেকে ধউর বেড়িবাঁধ ক্রসিং। সেখান থেকে কামারপাড়া হয়ে আব্দুল্লাহপুর ও টঙ্গীর মিলগেট এলাকায় দিব্যি চলছে রুট পারমিটবিহীন বাস, মিনিবাস, সিএনজি চালিত অটোরিকশা। শুধু তাই নয়, এসব যানবাহনের চালকদের বেশিরভাগেরই নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। ফলে নিয়মিতই দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাওয়ার পর গাড়ির নাম পরিবর্তন করেও চলছে যানবাহন।
অভিযোগ উঠেছে, ট্রাফিক পুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতাকর্মী এবং ওই এলাকার পরিবহন নেতাদের নিয়মিত খুশি করেই এ সব অবৈধ পরিবহন চলছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন সূত্র জানা গেছে, আশুলিয়া থেকে আব্দুল্লাহপুর, ধউর বেরিবাঁধ ক্রসিং দিয়ে অবাধে চলছে শতাধিক যানবাহন। পুলিশ প্রশাসনের চোখের সামনে এ সব অবৈধ যানবাহন চললেও কখনও আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না।
স্থানীয়দের অভিযোগ পুলিশকে ম্যানেজ করেই সবকিছু চলছে। দুর্ঘটনা ঘটলেও নেওয়া হয় না আইনগত কোনো পদক্ষেপ।
অবশ্যই ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কাছে সুনির্দষ্ট অভিযোগ এলে তারা সংশ্লিষ্ট যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন।
আব্দুল্লাহপুরের মামুন নামের এক ব্যক্তি ঢাকাপ্রকাশ’এর কাছে অভিযোগ করে বলেন, এই রাস্তায় চলে পুলিশের নৈরাজ্য। ট্রাফিক পুলিশ ও আশুলিয়া এলাকায় ডিউটিরত পুলিশকে ম্যানেজ করে তারা এ সব অবৈধ যানবাহন রাস্তায় নামায়। এ সব যানবাহনের পেছনে শুধু পুলিশ নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও জড়িত রয়েছেন।
জানা গেছে, রাজধানীর প্রবেশদ্বার ধউর বেড়িবাঁধ ক্রসিং দিয়ে আশুলিয়া এক্সপ্রেস, আশুলিয়া হাইওয়ে মিনিবাস ও আলহামদুলিল্লাহ পরিবহন নামে রুট পারমিট ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ি আবধে চলছে। এদের মধ্যে আলহামদুলিল্লাহ পরিবহনের নাম আগে ছিল বন্ধন পরিবহন। কিন্তু গত ২৭ জুন কামারপাড়ায় এক দুর্ঘটনায় বন্ধন পরিবহনের দুই যাত্রী মারা যাওয়ার পর নাম পাল্টে হয়ে যায় আলহামদুলিল্লাহ পরিবহন।
এ সব পরিবহন ছাড়াও গাজীপুর ও ঢাকা জেলার সিএনজি চালিত অটোরিকশাও কামারপাড়া ও ধউর বেরিবাঁধ ক্রসিং দিয়ে অবাধে রাজধানীতে ঢুকছে।
অভিযোগ উঠেছে, এই সড়কে প্রায় প্রতিদিনই অভিযানের নামে বিভিন্ন আন্তঃজেলা বাস, ট্রাক থামিয়ে প্রকাশ্যে চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁদা না দিলে গাড়িতে রেকার লাগানো হয়, মামলা দেওয়া হয়। ট্রাফিক বক্সে ডেকে নিয়ে মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
রুট পারমিট ও ফিটনেস ছাড়া কিভাবে আশুলিয়া-বেরিবাঁধ রুটে এসব গাড়ি চলছে জানতে চাইলে আশুলিয়া এক্সপ্রেসের ম্যানেজার মোহাম্মদ হাশেম বলেন, ‘আমাদের আশুলিয়া পর্যন্ত রুট পারমিট নেওয়া আছে। আর আশুলিয়া থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত যাওয়ার রুট পারমিটের জন্য আবেদন করা হয়েছে, এখনো অনুমতি পায়নি। তবে গাড়ি চালাতে তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
আশুলিয়া থানা পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তায় রুট পারমিটবিহীন গাড়ি, সিএনজি চালিত অটোরিকশা চলাচলে থানা পুলিশের কোনো সংশ্লিষ্ট্রতা নেই। তারা বলছেন, এর সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশ বা অত্র এলাকার যানবাহনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক নেতারা জড়িতে থাকতে পারে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এসব অবৈধ যানবাহন চলাচলের জন্য মাসিক চুক্তিতে ও এককালিন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার টিআই এবং সার্জেন্টকে ম্যানেজ করা হয়। যদিও ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এসব বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
শুধু রুটপারমিটবিহীন অবৈধ পরিবহনই নয়, বেশিরভাগ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। ট্রাফিক পুলিশের অভিযানে ধরা পড়লেও উৎকোচের বিনিময়ে ছাড়া পেয়ে যান। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিনা লাইসেন্সের গাড়ি চালককে আটক করে কারাগারে পাঠায়। কিন্তু এক-দুই মাস পর জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও একই কাজ করছে। আর লাইসেন্সবিহীন এসব চালকের হাতেই ঘটছে দুর্ঘটনা। এরা বেশিরভাগ সময় পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালায়। তাতে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।
এদিকে আন্তঃজেলা রুটে আব্দুল্লাহপুর কাউন্টার এলাকায় চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনের ম্যানেজারা আব্দুল্লাহপুর ট্রাফিক বক্সের টিআই আরাফাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলছেন, রুটপারমিট থাকা সত্ত্বেও এই টিআই গত কয়েকদিন ধরে গাড়ি আটকিয়ে ট্রাফিক বক্সে যোগাযোগ করতে বলেন।
আজমপুরে একটি বাস কাউন্টারের ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, কয়েকদিন আগে ধউর ক্রসিং এলাকায় আমার একটি গাড়ি আটক হলে ড্রাইভার আমাকে খবর দেয়। আমি আজমপুর কাউন্টার থেকে যেতে দেরি হওয়ায় টিআই আরাফাত আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। এরপর তাকে মাসিক দুই হাজার টাকা চুক্তিতে গাড়ি ছাড়িয়ে আনি। এটা কাউকে জানালে পরবর্তীতে সমস্যা হবে বলে তিনি হুঁশিয়ার করে দেন।
এ সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ধউর বেড়িবাঁধ ক্রসিং এলাকায় ডিউটিরত টিআই আরাফাত হোসেন বলেন, ‘আমি এখানে কয়েক মাস হল যোগদান করেছি। আমার বিষয়ে কিছু শুনতে হলে বা বলতে হলে আপনি সরাসরি আমার এখানে চলে আসেন সাক্ষাতে কথা হবে।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাফিক উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুল হক ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। প্রতিনিয়তই আমরা অভিযান পরিচালনা করে আসছি। তারপরও যদি সুনির্দিষ্ট কোনো গাড়ি থাকে (যাদের রুট পারমিট নেই) আপনারা যদি আইডেন্টিফাই করতে পারেন, তাহলে আমাদের জানাবেন। আমরা ঘটনাস্থলে থেকেই ব্যবস্থা নিব।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, রাজধানীতে গণপরিবহন চলাচলে এখনো অনেক বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। চাঁদাবাজি ,লাইসেন্সবিহীন চালক, ফিটনেসবিহীন ও রুটপারমিট ছাড়া গাড়ি রাস্তায় চলাচল করে থাকে। একটি বাস রাস্তায় চালাতে গেলে দিনে গড়ে বিভিন্ন সেক্টরে এক হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। এখানে বাস মালিকরা তাদের দায়িত্ব পালন করেন না। আবার চালকের লাইসেন্স আছে কি না, রুট পারমিট, ফিটনেস যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব বিআরটিএ ও পুলিশের। এ দুই সংস্থা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না বলেও অভিযোগ তার।
এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমানেসর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, যে কোনো ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো ধরণের অভিযোগ বা ঘুষের কোনো ঘটনা জানলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আমরা আইনত ব্যবস্থা গ্রহণ করি। আপনার কথা যদি সত্য হয় বা এর সঙ্গে যদি ট্রাফিক পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এনএইচবি/আরএ/