মেয়াদ শেষ হলেও ১৪ চিনিকলে স্থাপন হয়নি ইটিপি
চিনিকল। ফাইল ফটো
দেশের ১৪ চিনিকলে বর্জ্য পরিশোধণাগার (ইটিপি) স্থাপনের কাজে ভ্রমণ ভাতা বাবদ ১৪ লাখ টাকা, সম্মানী ভাতা ২৬ লাখ, প্রশিক্ষণে ২৭ লাখ, বিনোদনে ১০ লাখ, মোটরযান কিনতে ৭৫ লাখ, কাজের সাইট তৈরি করতে ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এ ছাড়া আসবাবপত্র কেনা পাঁচ লাখ, অফিস ও ল্যাব স্থাপনে এক কোটি ১০ লাখ টাকাসহ বিভিন্নখাতে ৮৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। যার মধ্যে ভ্রমণ, প্রশিক্ষণ, আসবাবপত্র ক্রয় ও ল্যাব স্থাপনে ইতোমধ্যেই প্রায় এক কোটি ২৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও ইটিপি স্থাপন প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি মাত্র ৫৯ ভাগ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে চিনিকলে ইটিপি স্থাপন সংক্রান্ত এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আইএমইডি এই মনিটরিং করে এবং গত জুন মাসে তা প্রকাশ করে।
দেশের প্রতিটি শিল্প কারখানায় বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থা্পনের জন্য ২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বছরের ২৩ জুন হাইকোর্টও ইটিপি স্থাপনের বিষয়ে আদেশ দেন। যাতে নির্দশনা ছিল এক বছরের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হয়। কিন্তু এসব আদেশ-নির্দেশের কোনোটিই দেশের চিনিকল কারখানার ক্ষেত্রে মান্য হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও আদালতের আদেশের পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতায় সরকার ১৪টি চিনিকলে বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত এসব ইটিপি বাস্তবায়নে প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। কিন্তু নির্ধারিত সময় দূরের কথা ডিপিপি দুই দফা সংশোধন করে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। তবু শেষ হয়নি ইটিপি স্থাপন প্রকল্পের কাজ। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৫৯ শতাংশ। আর পাঁচটি চিনিকল বন্ধ থাকায় আখের বর্জ্যের অভাবে কাজেই আসছে না এই প্রকল্প।
প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা জানতে রবিবার (১৭ জুলাই) প্রকল্প পরিচালক এবং বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক মো. শহিদুল করীমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি তথ্য কমিশনের ফরম পূরণ করে আবেদন করতে পরামর্শ দেন।
আইএমইডির প্রতিবেদন সম্পর্কে তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবেদনে যা পেয়েছেন লিখে দেন। এ ব্যাপারে আমার কোনো মন্তব্য নেই।
আইএমইডি’র প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ছয়টি চিনিকল বন্ধ ঘোষণা করায় আখ মাড়াই কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। এই সব মিলে ইটিপি নির্মাণ কাজ শেষ হলেও মিলে আখ মাড়াই স্থগিত করায় ট্রায়াল রান করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া অন্যান্য মিলে আখ মাড়াই মৌসুম সংক্ষিপ্ত হওয়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণ বর্জ্যের অভাবে ইটিপির কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। আবার যে সব মিলে ইটিপি নির্মাণ করা হয়েছে তা পরিচালনার জন্য লোকবলও নেই। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সঠিকভাবে চাহিদা নিরূপণের ভিত্তিতে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকায় ঠিকমতো কাজ হয়নি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কাজ সম্পন্ন না হলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ভ্রমণ ভাতা বাবদ ১৪ লাখ টাকা, সম্মানী ভাতা ২৬ লাখ, প্রশিক্ষণে ২৭ লাখ, বিনোদনে ১০ লাখ,মোটরযান কিনতে ৭৫ লাখ, কাজের সাইট তৈরি করতে ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এ ছাড়া অসবাবপত্র কেনা, অফিস ও ল্যাব স্থাপনে ১১০ লাখ টাকাসহ বিভিন্নখাতে ৮৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রতি অর্থবছরে অর্থ বরাদ্দও রাখা হয়। মাঝপথে দুই সংশোধন করে সময় বাড়ানো হয়েছে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত। ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫১ কোটি টাকা। কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৫৯ শতাংশ।
১৪টি ইটিপির মধ্যে ৯টির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। তবে এগুলোতে ট্রায়াল রান হয়নি। দুটির কাজ চলামান আছে। বাতিল করা হয়েছে তিনটির কাজ। আবার ২০২১ সালের ২২ মার্চ প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় পাবনা, শ্যামপুর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও রাজশাহী চিনিকলে ইটিপি প্ল্যান্টের স্থাপন কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে বাতিল করা হয়। পরে ২০২২ সালের ২২ মার্চ প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির সভায় রাজশাহী ও ফরিদপুর সুগারমিলে ইটিপির কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু মিল বন্ধ থাকায় আখের বর্জ্যের অভাবে তা কাজে আসবে না।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে— প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও বৈদ্যুতিক সংযোগ, ট্রান্সফরমার ক্রয় না করা এবং আখের পরিমাণ কমে যাওয়ায় বর্জ্যের অভাবে ইটিপিগুলোতে ট্রায়াল করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া ১৪টি চিনিকলে ল্যাব তৈরি হলেও ডিপিপিতে সরঞ্জাম কেনার কোনো খাত নেই। এতে ল্যাব ভবন কার্যকর হবে না। বর্জ্যর পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ থাকবে না। প্রকল্পের মধ্যে বাতিল করা শ্যামপুর সুগারমিলে কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৩০ শতাংশ, কুষ্টিয়ায় ৪০, ফরিদপুরে ৭৫, রাজশাহী ৪৫ ও পাবনা সুগারমিলে ৪০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। সার্বিকভাবে ইটিপি স্থাপনের অগ্রগতি হয়েছে ৮০ শতাংশ।
প্রকল্পের কাজ শেষের দিকে। তারপরও বড় ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। কারণ চিনিকলে ১২০ দিনের মাড়াই এর জন্য পর্যাপ্ত আখ পাওয়া না গেলে ও বর্জ্য পানি তৈরি না হলে ইটিপি চালানো যাবে না। ইটিপি পরিচালনায় জনবল নিয়োগ না করলে যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হবে না। এ ছাড়া কোনো কোনো মিলে বাউন্ডারির বাইরে ইটিপি করা হয়েছে। নিরাপত্তার অভাবে এসব চুরি হয়ে যেতে পারে।
উল্লেখ্য, চিনিকল এলাকায় কৃষিকাজ, জলাশয় ও সেচের পানিকে কারখানার বর্জ্য থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) ১৪ চিনিকলে বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, সেতাবগঞ্জ (রংপুর), শ্যামপুর (রংপুর), জয়পুরহাট, রাজশাহী, নর্থবেঙ্গল, পাবনা, কুষ্টিয়া, কেরু অ্যান্ড কোং (চুয়াডাঙ্গা), মোবারকগঞ্জ (ঝিনাইদহ), ফরিদপুর, ঝিলবাংলা (জামালপুর) ও রংপুর সুগার মিলে বর্জ্য পরিশোধনাগারগুলো স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
জেডএ/আরএ/