ডলার সংকট: ইনভয়েসিং-ওভারভয়েসিংয়ের বিরুদ্ধে অর্থনীতিবিদরা
অস্থির ডলারের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা বলছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে তারা বলছেন, ইনভয়েসিং ও ওভারভয়েসিং বন্ধ করতে হবে। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ববোর্ডকে আরও কঠোর মনিটরিং করতে হবে। এই সংকট ও দুঃসময়ে কঠোর মনিটরিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। কোনো প্রকারের শৈথিল্য দেখানো যাবে না।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলারও বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে ৪০ বিলিয়নের নিচে নেমে গেছে। টাকার মান কমিয়েও স্থিতিশীলতার কোনো কুলকিনারা হচ্ছে না। বছরের ব্যবধানে টাকার মান কমেছে ১০ শতাংশের উপরে। গত বছরের ৮৫ টাকার নিচের ডলার প্রায় ৯৪ টাকায় পৌঁছে গেছে। খোলা বাজারে সেটি ১০০ টাকায় পৌঁছে গেছে। ডলারের লাগামহীন অস্থিরতায় দেশের আমদানিকারক থেকে শুরু করে ভোক্তারাও শঙ্কিত, ভীত। কারণ ভোক্তাকে একই পণ্য বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আর আমদানিকারকরা বেশি ব্যয় করলেও আমদানি করতে পারছেন কম পণ্য।
অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, ‘বৈশ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে দেশেও ডলারের ব্যাপারে একটা সংকট চলছে। এ অবস্থা থেকে যেভাবে হোক সরকারকে বের হতে হবে। বেশি করে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাহলে দেশে ডলার আসবে। আমদানি ব্যয় খুবই টাইট করতে হবে। মুদ্রানীতিতে তা মানতে হবে। ব্যাংকের ইন্টারেস্ট রেট (সুদ হার) বাড়িয়ে দিতে হবে। আমানত ও ঋণের ক্ষেত্রে ৬-৯ শতাংশ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আগে থেকে প্রস্তাব করে লাভ নেই। কারণ গ্যাস, তেল ও সারের দাম বেড়ে গেছে। তাই বাস্তবতা মানতে হবে। এটা করব না, ওটা করব না। এভাবে সময় পার করে লাভ হবে না। বাস্তবতা না মানলে সরকার দায়ী হবে।
ব্রিটেনে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘বাস্তবতা মেনে ব্রিটিশ সরকার কিছু করলে আমাদের সমস্যা কোথায়। তাদের মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। দুই দিনেই সম্ভব যদি সরকার বাস্তবতা মেনে কিছু করে। তবে এ কাজে কিছু কষ্ট স্বীকার করতে হবে সরকারকে, সঙ্গে জনগণকেও। কারণ গ্যাস ও তেলের আমদানি কমিয়ে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে হবে। এসির ব্যবহার কমাতে হবে। বর্তমানে যেহেতু সময় ভালো যাচ্ছে না। বিশ্ব বাজারে ওই সব জিনিসের দাম কমলে তখন ভিন্নভাবে ভাবতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদেরও পরামর্শ হচ্ছে যেভাবে হোক আমদানি কমাতে হবে। ঢাকাপ্রকাশ’কে তিনি বলেন, ‘আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলারের চাহিদা বেড়েই যাচ্ছে। এতে দামও বেড়ে যাচ্ছে। টাকার মান বারবার অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। এটা চিস্তার বিষয়। তবে যেভাবে হোক অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমাতে হবে।
ওভার ভয়েসিং ও ইনভয়েসিং বন্ধ করতে হবে। জাতীয় রাজস্ব রোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংককে এক সঙ্গে এসব দেখতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে মনিটরিং বাড়াতে হবে। সরকারকে পণ্যের বহুমুখীকরণে আরও নজর দিয়ে রফতানি বাড়াতে হবে। যাতে বেশি করে ডলার আসে। একই সঙ্গে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়াতে হবে। এভাবে সরকার কঠোর হলে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানও বলছেন, আগে থেকে ধীরে ধীরে টাকার অবমূল্যায়ন করা হলে ডলারের বাজারে এতো সংকট হতো না। ঢাকাপ্রকাশ’কে তিনি বলেন, ‘সরকার আমদানি ব্যয় কমাতে ১০০ শতাংশ ঋণ মার্জিনসহ কিছু ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিয়েছে। আরও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। নিত্যপণ্য ছাড়া যাতে কোনোক্রমেই বিলাসী পণ্য আমদানি না হয়। তা স্থগিত রাখতে হবে। সরকারকে আরও দেখতে হবে রফতানি ও রেমিট্যান্স যাতে বাড়ে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট অব ব্যালান্স সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ‘সরকার ব্যয় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখে। তেল, গ্যাস ও সার সরকারিভাবে আমদানি করতে হয়। তাই এসব পণ্য আমদানি করতে রিজার্ভ কমলেও সেটা নেতিবাচকভাবে দেখার বিষয় না। আবার আমাদের ঋণ পরিশোধও বেশি করে করতে হয় না। তবে যেভাবে হোক ইনভয়েসিং ওভারভয়েসিং বন্ধ করতে হবে এনবিআর ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রকারের শৈথিল্য দেখানো যাবে না। একই সঙ্গে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আরও বাড়াতে হবে। সরকারকে সেদিকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি ব্যয় হয়েছে ৫৩ হাজার ৩৭ মিলিয়ন (৫ হাজার ৩০৩ কোটি) ডলার। যা বিদায়ী অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ৭৬ হাজার ৬৫১ মিলিয়ন (৭ হাজার ৬৬৫ কোটি) ডলার। বছরের ব্যবধানে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ।
অপরদিকে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত রফতানি আয় হয়েছে ৪৩ হাজার ৩৪৪ মিলিয়ন ডলার। যা বিদায়ী অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩২ হাজার ৭২ মিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এভাবে প্রতি মাসে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে বাণিজ্য। এর ফলে আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলারের চাহিদা বাড়ছে।
সদ্য বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবিরও বলেছেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি আয় ও আমদানি ব্যয় উভয়ই বেশি। তবে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কম হওয়ায় চলতি হিসাবের ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ১০ মাসে চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমান ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল মাত্র এক দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। এই ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বছরের ব্যবধানে ৪৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন থেকে কমে ৪১ দশমিক ৮ বিলিয়নে নেমে গেছে। টাকার বিনিময় হারের উপরও চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ২০২১ সালের জুনে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ দশমিক ৮১ টাকা। ২০২২ সালের জুনে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯২ দশমিক ৯৫ টাকা। তাই চলতি অর্থবছরে মুদ্রানীতির মূল চ্যালেঞ্জ হবে টাকার মানকে স্থিতিশীল রাখা। এ জন্য সর্তকতামূলক মুদ্রানীতি ভঙ্গি অনুসরণ করা হয়েছে। যা কিছুটা সংকোচনমুখী।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে গত বুধবার(১৩ জুলাই) প্রতি ডলার বিক্রি করেছে ৯৩ টাকা ৬২ পয়সা দরে। গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ। সব মিলিয়ে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৩ দিনে (১ থেকে ১৩ জুলাই) ৫৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। তার উপর আমদানি ব্যয় মেটাতে হচ্ছে। ফলে দুই বছর পর গত বুধবার (১৩ জুলাই) দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।
জেডএ/এনএইচবি/আরএ/