বিদেশিদের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগ, সন্দিহান আওয়ামী লীগ
আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের বিশেষ সুবিধা পাওয়া বিএনপিতে এখন আগের পরিস্থিতি নেই। নানান কারণে বন্ধুসুলভ দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল সেটি এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি দলটি। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে এবং আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে বিএনপি নেতারা সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক জিন লুইসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
এ ছাড়া বিএনপি নেতারা ঢাকা নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও বৈঠকে করছেন।
অন্যদিকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে দলটির সংশ্লিষ্ট উইংগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। তারা সরকারের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, গুম-খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, মিটিং-মিছিল করতে না দেওয়া, ইভিএমের কারচুপি, দিনের ভোট রাতে হওয়া, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের নেতিবাচক দিক, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ‘যৌক্তিকতা’- এসব বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরছেন।
বিষয়টাকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। ইতিমধ্যে দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপিকে বিদেশিদের পেছনে দৌড়ঝাঁপ না করে জনগণের কাছে যাওয়া উচিত।
আর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি এবং ভোটে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে আন্তর্জাতিক বিষয়ে বিএনপির সংশ্লিষ্ট নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রাজনৈতিক বিশ্বাস-আস্থার সম্পর্ক স্থাপনে কার্যত কোনো উদ্যোগই অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে হচ্ছে বলে দলটির ভিতর থেকেই অভিযোগ উঠেছে। অথচ জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগের বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা করতে গিয়ে দেশীয় রাজনৈতিক সমীকরণে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক শক্তিকে পাশে পেয়েছিল বিএনপি।
বিএনপি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে দলটি। তা নিয়ে দলটির নেতা–কর্মীদের মধ্যে দ্বিমত নেই। তবে তারা বলছেন, নীতি–কৌশল নির্ধারণে নেতৃত্বের মধ্যে যে ঐক্য, সংহতি দরকার, সেখানে ঘাটতি আছে দীর্ঘ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির। দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। যদিও অসুস্থতার কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে কারাগারের বাইরে রয়েছেন। তবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তার অবর্তমানে লন্ডনে নির্বাসিত বড় ছেলে তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দল পরিচালনা করছেন। কাজেই বলতে গেলে দলের একক ক্ষমতার অধিকারী এখন তারেক রহমান। নিজেই দলের সব বিষয়ে তদারকি করছেন। কোথাও সফল হচ্ছেন, কোথাও ব্যর্থ হচ্ছেন। আন্তর্জাতিকভাবে বিএনপি রাজনীতি নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজন নেতা ঢাকাপ্রকাশ-কে এসব কথা জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি অনেক কিছুতেই সিদ্ধান্তহীন। আন্দোলন নাকি নির্বাচনের প্রস্তুতি-এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতার দুই ছকে আটকে গেছে দলটির বৈদেশিক রাজনৈতিক দৌড়ঝাঁপ। নীতি-কৌশলসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও এই বিষয়ে দলটির নেতাদের অভিযোগ-সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আটকে আছে খালেদা জিয়ার রাজনীতি। এই অবস্থায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান সংলাপে অনেকটাই ঘুরে দাড়ানোর পথ খুঁজছে বিএনপি। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলে দলটির পক্ষ থেকে জোরালো যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছে দলটির দায়িত্বশীল নেতারা। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক জিন লুইসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতারা।
বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ অংশ নেন। বৈঠক সূত্রের দাবি, আগামী নির্বাচন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের আলোচনা হয়েছে।
কূটনৈতিক বিষয় নিয়ে কাজ করছেন বিএনপির এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বিগত দিনে কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল, তাই এখন এসব বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলার সময় না। তবে এতটুকু বলতে পারি কূটনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি তার অবস্থান গুরুত্ব তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে বার বার বলে আসছে-শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই নয়, পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংস্থা চায় বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় নির্দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচন গ্রহণেযাগ্য হবে না।
দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্যে শুধু আন্দোলনেই সীমিত থাকছে না। মাঠের আন্দোলনের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি পুনর্গঠন করেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেক্ষেত্রে বিগত নির্বাচনি ইতিহাস, দলীয় সরকার এবং নির্দলীয় সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হবে। এ লক্ষ্যে বিএনপির আন্তর্জাতিক কমিটির নেতারা কাজ করে যাচ্ছেন।
বিদেশীদের কাছে বিএনপির এই দৌড়ঝাঁপকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন না আওয়ামী লীগ নেতারা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপি সব সময় বিদেশিদের কাছে ছুটে যায়। তাদের দৌড়-ঝাঁপ সব সময় বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের কাছে, বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার কাছে। অথচ এদেশের মালিক হচ্ছে এদেশের জনগণ। জনগণই হচ্ছেন ক্ষমতার মালিক। তারাই প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। এদেশে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রদূত বা আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি কাউকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসানোর অধিকার রাখে না। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানো সমীচীন নয়। বিএনপির উচিত বিদেশিদের কাছে দৌড়ঝাঁপ না করে জনগণের কাছে যাওয়া। এটা বিএনপির জন্য মঙ্গল হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণ যাদের ভোট দিয়ে নির্বাচন করবে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতসহ যত ক্ষমতাশালী দেশের হোক না কেন তারা বাংলাদেশের নির্বাচনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, বিদেশিরা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। পুরো পৃথিবী একটা গ্লোবাল ভিলেজ। বিএনপি তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারে। তবে আমরা চাই গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হোক। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অবশ্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি একটা বড় রাজনৈতিক দল, তিনবার রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিল। স্বাভাবিকভাবেই দলটির সঙ্গে দেশি বিদেশি ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান কিংবা সংস্থার যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। ফলে বিদেশি যারাই দেশে নতুন আসেন, তারাই দেখা করতে আসেন।নর্মাল কার্টেসি কল। আমরা মিটিং করি। এটা সাধারণ
কূটনৈতিক রীতি।
এমএইচ/এনএইচবি/এমএমএ/