চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ লাবু-জলিলরা গরু নিয়ে আর ঢাকা আসবে না
একটু লাভের আশায় যশোরের বেনাপোল থেকে গরু নিয়ে ঢাকায় এসেছেন লাবু মিয়া। গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে জেনেছেন গরু ঢাকায় নিয়ে গেলে বেশি দাম পাওয়া যায়। তাই সাহস করে ছোট একটা ট্রাক ভাড়া করে একটা গরু নিয়ে ঢাকায় আসেন। কিন্তু বেনাপোল থেকে দৌলতদিয়া-আরিচা ঘাট হয়ে গাবতলী হাটে পৌঁছাতে তাকে গুণতে হয়েছে অনেকগুলো টাকা।
সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে পথে । শুধু তাই নয়, চাঁদা না দিলে পথেই গরু নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এমন চাঁদাবাজির কবলে পড়ে ত্যক্ত বিরক্ত লাবু বলছেন, আর কখনো তিনি গরু নিয়ে ঢাকায় আসবেন না।
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে এখন দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা থেকে গরু আসছে ঢাকার পথে। লাবুর মতো আরও অনেকেই গরু ঢাকার বাজারে নিয়ে আসতে পথে চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন। পুলিশও এই চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করছে।
অথচ সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী গত সপ্তাহেই কোরবানির পশু নিয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বলেছিলেন, বাজারে গরু আনতে গিয়ে যেন কেউ চাঁদাবাজির শিকার না হন। এ ব্যাপারে পুলিশকে সতর্ক থাকার কথাও বলেছিলেন তিনি। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীতে মোট ১৮টি পশুর হাট বসছে। ইতিমধ্যে এসব হাটের প্রায় সব কয়টির প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। হাটের কিছু কিছু কাজ বাকি থাকলেও দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছেন ইজারাদার কর্তৃপক্ষ।
রাজধানীর এসব হাটকে ঘিরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরু আসতে শুরু করেছে। কিন্তু সেই গরু নিয়ে হাটে এসে বিভিন্ন ভোগান্তিতে পড়ছেন বেপারিরা। একে তো পথে পথে দিতে হচ্ছে অনেক চাঁদা। তার উপর আবার হাটের যে স্থানে পশু রাখা হবে সেসব স্থানে গরু রাখার জন্য ভালো জায়গা পেতে একটি গরুতে ১২ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে।
অতিরিক্ত এসব টাকা রীতিমত অত্যাচার বলে জানাচ্ছেন গরুর বেপারিরা। তবে, হাট কর্তৃপক্ষ বলছে বিক্রেতারা একটু বাড়িয়ে বলছে।
গরুর বেপারি ও বিক্রেতারা বলছেন, আমিন বাজারে গরুর ট্রাক এলেই ১০ থেকে ১৫ জন যুবক ট্রাকে হামলা করে। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছোট ছোট লাঠি। বেশ কয়েকজনের গায়ে ইজারাদার গাবতলী লেখা এবং হলুদ পোশাক পরিহিত। তারা ট্রাক আটকে ঈদের খরচ দাবি করেন। তবে তাদের ভাষ্য এটা চাঁদা না, ঈদের বোনাস! ট্রাকচালককে ওই যুবকেরা হুমকি দিয়ে বলেন, টাকা দেওয়া ছাড়া ট্রাক চালাতে পারবি না।
এদিকে সাভার মডেল থানা পুলিশ বলছে, হাটের লোক, গরু বিক্রেতা এবং ব্যবসায়ীরা আমাদের বলেছে আমিন বাজারে গরু নিয়ে ঢাকায় প্রবেশের পথে বেশ কিছু যুবক চাঁদা বা কিছু সমস্যা তৈরি করছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তাদের সনাক্ত করার চেষ্টা করছি।
সাভার মডেল থানার ওসি কাজী মঈনুল ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা গরু ব্যবসায়ী ও বিক্রেতাদের নিকট থেকে চাঁদাবাজিসহ বেশ কিছু হয়রানীর অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলো আমরা তদন্ত করছি এবং এসব আমলে নিয়েই কাজ করছি।
তিনি বলেন, আমাদের থানা এলাকায় পশুর হাটে বা গরুর ট্রাক নিয়ে কেউ কোনো ধরনের সমস্যায় পড়লে সাভার থানা পুলিশকে জানালেই এর সমাধান হবে।
অস্ট্রেলিয়ান জাতের একটি গরু নিয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে গাবতলী হাটে এসেছেন আবু জলিল মিয়া। রবিবার তিনি ঢাকায় আসেন। শাহেনশা নামের ওই গরু নিয়ে তিনি ঢাকার গাবতলী হাটে প্রবেশ করেন।
তিনি বলেন, গরু আর কখনো ঢাকার হাটে আনব না। কারণ, যা লাভ হয় তা রাস্তায় (চাঁদা) খরচ হয়ে যায়। তা ছাড়া এত বড় গরু আনতেও ভয় লাগে।
গাবতলী হাটে কথা হয় আরেক গরুর মালিক মমিনুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার গরুটি একটি স্থানে রাখার জন্য এই জায়গার ২০-২৫ হাজার টাকা দিতে হবে। অর্ধেক টাকা জমা দেওয়া আছে। এবার হাটের লোক অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে। ডাকাতি চলছে। গরু বিক্রি করতে না পারলেও এই টাকা আমার পকেট থেকে যাবে।
গাবতলী হাটে গরুর গোসল করানোর কষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ময়মনসিংহের গরুর বেপারি আবুল তাহের। তিনি বলেন, বিভিন্ন জায়গায় এক সঙ্গে গরু গোসলের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এখানে নেই। এবার ঢাকায় গরু নিয়ে আসার পথে মহাসড়কে ব্যাপক চাঁদাবাজি হচ্ছে যা দেখার কেউ নেই।
পাবনা থেকে গরু নিয়ে আসা মো. সেলিম মিয়া বলেন, সাড়ে ৩ বছর গরুটি লালনপালন করেছি। গতকাল রাতে এসেছি গাবতলী হাটে। এখানে আসতে রাস্তায় ১০-১৫ জায়গায় চাঁদা দিতে হয়েছে। এজন্য বেশি দামে গরু বিক্রি করতে হবে।
ঝিনাইদহ থেকে গরু নিয়ে আসা আবুল হোসেন বলেন, পশু নিয়ে বের হলেই হাটে ঘাটে ব্যাপক চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা কবে বন্ধ হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাবতলী হাট পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক (সদস্য) ছানোয়ার হোসেন বলেন, আমরা গরু রাখার জন্য সামান্য টাকা রাখছি। একটা গরুর পেছনে অনেক খরচ আছে। তারা সেটা বলছে ওটা মিথ্যা কথা। অতিরিক্ত টাকা কারো কাছ থেকে নিচ্ছি না। সবাইকে আমরা সমান ভাবে দেখছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হাফিজ আল আসাদ বলেন, যে সব এলাকায় গরুর হাট রয়েছে সেসব জায়গায় আমাদের মেট্রোপলিটন পুলিশ সর্তক অবস্থানে রয়েছে যাতে গরু ব্যবসায়ী বা বিক্রেতদের কোনো সমস্যা না হয়। তা ছাড়া কোরবানির পশু নিয়ে কেউ ঝামেলায় পড়লে আমাদের পুলিশের সদস্যরা তাদের বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করছেন। তবে, চাঁদাবাজির বিষয়টি এখনো আমাদের নজরে আসেনি। এসব বিষয়ে অভিযোগ পেলে অবশ্যই আমরা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মহাসড়কে কেউ চাঁদাবাজি করলে সে যেই হোক তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
তিনি বলেন, বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে গরু নিয়ে আসবে তাদেরকে কোনো চক্র বিরক্ত করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনতগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মহাসড়কে র্যাবের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত টহল বাড়ানো হয়েছে।
কেএম/এনএইচবি/এমএমএ/