বিতর্কের মধ্যেই ‘পাচার টাকা’ ফেরার সুযোগ
অর্থ পাচাররোধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন থাকলেও অর্থ পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। বাণিজ্যের আড়ালেই বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। সেই টাকা এখন ফেরত আনতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ৭ শতাংশ করে পাচারকৃত টাকা ফেরত আনতে পারবেন পাচারকারীরা।
গত বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘বিভিন্ন সময়ে দেশ থেকে টাকা বিভিন্ন দেশে চলে গেছে। তা ফেরত আনা হবে। কেউ বাধা দেবেন না।
কিন্তু তার এ উদ্যোগের বিরোধীতা করছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ এমনকি খোদ পরিকল্পনামন্ত্রী। তারা বলেছেন, এটি আইনগতভাবে বৈধ করা হলেও নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তারপরও অর্থমন্ত্রীর দাবির কারণে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার সুযোগ করে ৩০ জুন জাতীয় সংসদে তা পাশ হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী ৯ জুন সংসদে দেওয়া বাজেট বক্তব্যে বলেন, ‘বিদেশে থাকা যেকোনো সম্পদের উপর কর পরিশোধ করা হলে এনবিআরসহ অন্য কোনো সংস্থা এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না। স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং নগদ টাকা আনতে চাইলে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করা যাবে। চলতি বছরের জুলাই থেকে আগামী ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এ সুযোগ দেওয়া হবে। এর এক দিন পর অর্থমন্ত্রী বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যারা টাকা ফেরত আনবেন তাদের শতভাগ গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে।‘
বাজেটের কোনো ব্যাপারে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ এমনকি পরিকল্পনামন্ত্রী এক সুরে কথা না বললেও পাচারকৃত টাকা ফেরত না আনার ব্যাপারে একাট্রা। এ ব্যাপারে সবার একই বক্তব্য এটা অনৈতিক ও গ্রহণযোগ্য নয়।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বাজেট অনুমোদনের পর স্পষ্ট বলেছেন, ‘এবারের বাজেটে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার সুযোগ আইনগতভাবে বৈধ করা হলেও নৈতিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ থেকে যে পরিমান টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে আইনের বৈধতা দিয়েও তা পুরোপুরি ফেরত আনা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে এক শ্রেণির মানুষের কাছে প্রচুর টাকা রয়েছে, যে টাকা নানাভাবে পাচার হচ্ছে। যেসব দেশে টাকা পাচার করা হয় সে সব দেশের সরকার অর্থের বৈধতা যাচাই না করেই তা বিনিয়োগের সুযোগ করে দিচ্ছে।
এর আগে বাজেট ঘোষণার পরও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘কেউ ফিরিয়ে আনার জন্য টাকা পাচার করে না। কোনো চোর ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য টাকা চুরি করে না। তাই সরকার সুযোগ দিলেও টাকা ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। তবে টাকা যাতে দেশ থেকে বেরোতে না পারে, সেই চেষ্টা করা উচিত।‘
দেশে ২০০২ সালে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয়। এটা জারির মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে অপরাধ মুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সরকারের সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছে। তা বাস্তবায়নে বিএফআইইউ বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে। তারপরও ঠেকানো যাচ্ছে না অর্থপাচার।
বাধ্য হয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, ‘পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনলে কথা দিচ্ছি কোনো প্রশ্ন করা হবে না। আমি যেটি বলেছি, সেটি করব। কেউ বাধা দেবেন না। আমি অর্ধেক রাস্তা থেকে ফিরে আসি না।’
শেষ পর্যন্ত ৩০ জুন শুধু ৭ শতাংশ কর পরিশোধ করে পাচার করা টাকা এক বছর ফেরত আনার সুযোগ পাশ হয়েছে সংসদে।
দেশের স্বার্থে অর্থমন্ত্রী এটা করতে চাইলেও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি, টিআইবি, শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইসহ দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা এই সুযোগের সমালোচনা করে বলছেন, এটা শুধু ন্যায়-নীতি বিরোধীই নয়, এটি অনৈতিক ও অগ্ৰহণযোগ্য। এর ফলে ঘুষ-দুর্নীতি উৎসাহিত হবে। টাকা পাচার আরও বাড়বে। এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন।
সূত্র জানায়, অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন তদন্ত করতে গিয়ে সাড়ে ৫ হাজার লেনদেনকে সন্দেহজনকভাবে শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সসিয়াল ইন্টালিজেন্স ইউনিট (বিএফইইউ)। চলতি অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি) গ্রাহকের সোয়া দুই কোটির বেশি লেনদেন যাচাই করে এই তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। মানিলন্ডারিং, অর্থপাচার, জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন, ঘুষ-দুর্নীতি বা বেআইনি কোনো লেনদেনের বিষয়ে সন্দেহ হলে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা অন্য প্রতিবেদন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিএফআইইউয়ের কাছে রিপোর্ট করে, যা সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) হিসেবে পরিচিত।
বিএফআইইউর প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশের কৌশলগত দুর্বলতা এবং উদার অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে লন্ডারিংকৃত অর্থ সহজেই বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবে ঢুকে পড়ে। আবার খুব সহজে ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়। এসব অবৈধ অর্থ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোনোরূপ ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিপুল অর্থপাচারের কথা বলা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য বিশ্লেষণ করে এর মিল খুঁজে পায় না। সুইস ব্যাংকে মোট জমার ৯৭ শতাংশ।
জেডএ/আরএ/