সমমনাদের নিয়েই সরকারের পতন ঘটাতে চায় বিএনপি
সন্দেহ, সংশয় আর অনিশ্চয়তায় দোলাচলে দুলছে দেশের রাজনীতি। আগামী নির্বাচনে কী হবে বা কী হতে যাচ্ছে— এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে জল্পনা-কল্পনা। ক্ষমতাসীনরা বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনে যথাসময়ে নির্বাচন হবে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না তারা। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করে তাদের অধীনে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে আগামীতে নির্বাচন করতে হবে। সেই লক্ষ্যে বিএনপি সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে। এ কারণে তারা সরকারের কোনো সংলাপে সাড়া দিচ্ছে না। তবে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে তাদের এই সংলাপ ও সরকার পতনের আন্দোলন কতটা সফল হবে তা নিয়েও সংশয় আছে।
২০১৮ সালে একাদশ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংলাপে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। সংলাপের পর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভোটযুদ্ধের ভরাডুবিতে সংসদে তাদের আসন সংখ্যা মাত্র ৬টি।
অতীত অভিজ্ঞতার কারণে এবার নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপে সাড়া দেয়নি দলটি। শুধু সাড়া না দিয়ে বসে থাকেনি বরং রাষ্ট্রপতির সংলাপকে অর্থহীন ও লোক দেখানো বলেও অবহিত করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ডাকা সংলাপেও অংশ নেওয়া থেকে বিরত থেকেছে বিএনপি।
তবে গত ২৪ মে সরকার বিরোধী সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে দলটি। সংলাপের উদ্দেশ্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ে সরকারবিরোধী একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে রাজপথে আন্দোলন জোরদার করা। ইতোমধ্যে বেশকয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শেষ করেছে দলটি। এসব সংলাপে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পৌঁছাতে সক্ষম হবে বলে আশা করছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
অবশ্য রাষ্ট্রপতি ও নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ না নেওয়া প্রসঙ্গে এবং বর্তমান সংকট উত্তরণে দলের অবস্থান তুলে ধরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশের চলমান সংকট উত্তরণে আমাদের স্পষ্ট কথা, সবার আগে গণতন্ত্রের প্রতীক, স্বাধীনতা-সার্বেভৌমত্বের প্রতীক বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে জনগণের ভোটের ক্ষমতাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এটাই হচ্ছে একমাত্র পথ। এর বাইরে আর কোনো পথ নেই।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন আদায়ে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। অতীতে বেশ কয়েকবার সংলাপেও অংশ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি শুধু বিএনপি নয়, বিএনপির এই দাবির সঙ্গে সুর মিলিয়ে সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোও কথা বলতে শুরু করেছে। ফলে আমরা তাদের সঙ্গে সংলাপ করছি। আশা করছি শিগগিরই আমরা সবাই মিলে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারব।
তিনি বলেন, তবে যাদের কে আমরা মানি না তাদের সঙ্গে কিংবা তাদের ডাকা সংলাপে অংশ নেওয়া হবে লোক দেখানো ও অর্থহীন। নিকট অতীতে সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অন্তত এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
বিএনপি নেতারা বলেছেন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসেই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে সংলাপ করা হয়েছে। সবার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। বাকি দলগুলোর কাছ থেকেও একই ধরনের সাড়া পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কারণ সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সবার লক্ষ্য একই। সংলাপ থেকেই দাবি আদায়ে করার সেই লক্ষ্যে যুগপৎ আন্দোলন করার কথা ভাবা হচ্ছে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি বৃহত্তর ঐক্যের রূপরেখা তৈরি করে তা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে বলেও জানান দলটির নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপির সঙ্গে ভোট জোটে ঝুলে থাকা বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর সম্পর্ক নিয়েই জনগণের একটি বৃহৎ অংশের আতঙ্ক ও উদ্বেগ থাকছেই। অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াত ইসলামী যুগপৎ আন্দোলন করেছে তাই ১৯৯৬ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে এসেও জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন করে ক্ষমতায় যাওয়ার কারণে যুদ্ধাপরাধী বিচারে অগ্রসর হয়নি। তবে থেমে থাকেনি আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালে নির্বাচনে ফের ক্ষমতায় গিয়ে ওই বিচারকার্য শুরু করে নিজের কালিমালেপন মুছতে কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। পক্ষান্তরে বিচারের মুখে জামায়াতের আন্দোলনে সঙ্গী হিসেবে বিএনপিকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, ‘আমরা যদি অতীতের মতো ক্ষমতাসীনদের তৈরি ফাঁদে পা না দিয়ে তাদের অধীনে এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাব না এই সিদ্ধান্তে অটল থাকি তাহলে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলমান সংলাপের ফলাফল অবশ্যই ইতিবাচক হবে, হতে বাধ্য।’
তিনি বলেন, রাজনীতিতে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, সংলাপটা কার সঙ্গে হবে? কারণ একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে সংলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু যারা অনির্বাচিত যাদের প্রতি জনগণের কোনো ম্যান্ডেট নেই, জনগণের প্রতি যাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই তাদের সঙ্গে সংলাপে কোনো ফলাফল আসে।
এমএইচ/আরএ/