শিক্ষার্থীদের অবক্ষয়, কে দায়ী!
ছবি: সংগৃহীত
সাভারে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তারই ছাত্র জিতু। নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সামনে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত করেছে শিক্ষার্থীরা। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আরও অনেক জায়গায় মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
চলমান এসব ঘটনা শিক্ষক সমাজের জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, কোনো একটি ঘটনার পর একজন বা দুইজন শিক্ষার্থীকে শাস্তি দিলেই এর সমাধান হবে না। খুঁজে বের করতে হবে শিক্ষার্থীরা মানুষ হতে এসে কেনো অমানুষ হচ্ছে?
এরজন্য শুধু শিক্ষার্থীদের দায়ী করতে চান না শিক্ষকরা। তারা মনে করেন এর পেছনে অনেকগুলো অনুসঙ্গ কাজ করে। শিক্ষার পরিবেশ, ক্ষমতার প্রভাব, খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকা। তাছাড়া তথ্য প্রযুক্তি আমাদের জন্য আর্শিবাদ হলেও পশ্চিমা সংস্কৃতি দেখে তরুণ শিক্ষার্থীরা অকেটাই বিপথে চলে যাচ্ছেন বলে মনে করেন দেশের বরণ্যে শিক্ষকরা।
এই অবস্থা থেকে এখনই তরুণ সমাজকে ফেরাতে না পারলে আমাদের জাতি মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হবে এমন আশঙ্কা শিক্ষকদের। তারা বলছেন, আগামীতে যারা দেশের নেতৃত্ব দেবেন বিভিন্ন জায়গায়, তারাই যদি নৈতিক অবক্ষয়ে তলিয়ে যান তাহলে তো দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে।
একটি দেশের মেধাবী তরুণ সমাজই সেই দেশের স্তম্ভ ধরা হয়। সেই স্তম্ভ যদি ভেঙে পড়ে তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কোথায় দাঁড়াবে। গত দুই বছরে করোনার কারণে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ব্যাহত হওয়ার প্রভাবও শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার পতন ঘটিয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।
গত কয়েক দিনের ঘটনা সারাদেশের শিক্ষক সমাজ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গনে নাড়া দিয়েছে। এর প্রভাবে শিক্ষাঙ্গনে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। অতি সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছিত শিক্ষকরা সামাজিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
গত ২৫ জুন দুপুরে আশুলিয়ার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে স্কুলমাঠে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে আহত করে ওই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম জিতু। দুদিন পর সেই শিক্ষক মারা যান।
তার আগে নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী দ্বারা লাঞ্ছিত হন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক স্বপন কুমার বিশ্বাস।
সম্প্রতি ফেসবুকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নূপুর শর্মার সমর্থনে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক শিক্ষার্থীর পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। এরপর গুজব ছড়িয়ে পড়ে পোস্ট দেওয়া ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। এ ঘটনার পর পুলিশ পাহারায় তাকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় তাকে দাঁড় করিয়ে পুলিশের সামনেই গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা হয়। পরে তাকে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আইন বিভাগের ক্লাস চলাকালীন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠে একই বিভাগের মাস্টার্সের আসিক উল্লাহ নামের এক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী শিক্ষক ড. বেগম আসমা সিদ্দিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক।
গত শুক্রবার (১জুলাই) রাজধানীর উত্তরায় নিজের বাসার গেটে অপদস্থ করা হয় অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকীকে।
শুধু এ কয়েকটি নয়, আরও অনেক ঘটনা ঘটছে যেগুলো হয়ত মান সম্মানের ভয়ে গণমাধ্যমে সেভাবে তুলে ধরছেন না শিক্ষকরা। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
শিক্ষকদের লাঞ্ছনা ও শিক্ষার্থীদের নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, একটা ঘটনা আর একটা ঘটনার জন্ম দেয় সেটা যেমন ঠিক। পাশাপাশি শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থান খুব দুর্বল। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য। অনেক প্রতিষ্ঠানের সভাপতির আত্মীয়রা যখন ওই প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে থাকে তখন তাদের মধ্যে একটা ‘পাওয়ার’ চর্চার প্রবণতা দেখা যায়।
তিনি বলেন, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা হাতে পায়ে চোখে হয়ত মানুষের আকার ধারণ করেছে কিন্তু অন্তরে তারা মানুষের আকার নিতে পারেনি। এরজন্য শিক্ষার্থীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। সমাজের বিভিন্ন স্তরে মানুষরূপী অমানুষের দেখা পাওয়া যায়। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানবাত্মার উৎকর্ষের উপর গুরুত্বারোপ প্রয়োজন।
এরজন্য কি শুধু ছাত্র-ছাত্রী দায়ী এমন প্রশ্নের জবাবে আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, না, শিক্ষক-অভিভাবকরাও দায়ী। আমরা অভিবাবকরা চাই ছেলে-মেয়ে যেন জিপিএ-৫ পায়। আর শিক্ষকরাও চান তার প্রতিষ্ঠানে বেশি সংখ্যক জিপিএ-৫ আসুক। এই প্রতিযোগিতায় নেমে মানবিক গুণসম্পন্ন শিক্ষার্থী হারিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনে যারা আছেন তারাও জিপিএ-৫ শিক্ষার্থী খোঁজেন। এখানে শুধু শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিলেই সমাধান হবে না। এর পেছনের কারণগুলো খুঁজে বের করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। মানবাত্মার বিকাশ ঘটাতে হবে।
চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ইউনির্ভাসিটির উপাচার্য ও সমাজ বিজ্ঞানি ড.অনুপম সেন ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, করোনার কারণে দুই বছর শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে যে একটা সম্পর্ক সেটাকে নষ্ট করেছে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা ঘরবন্দি থেকে মানসিক ভাবে যন্ত্রণায় ভুগছে। আর শহরগুলোতে খেলাধুলার মাঠ কমে যাওয়াও বড় কারণ। শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পর দিনের বড় একটা সময় মোবাইল ফোনে ডুবে থাকে, এতে নৈতিক শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া দেশে সাংস্কৃতিক চর্চা কমে যাচ্ছে। এই অবস্থাগুলোর যত অবক্ষয় হবে ততই শিক্ষিত সমাজ বিপথে যাবে।
এনএইচবি/আরএ/